ফোনের ও পারে কে? সিবিআই-তলবের খবর আসার পর উদ্বিগ্ন মুকুল রায়। নয়াদিল্লিতে সোমবার। ছবি: রমাকান্ত কুশওয়াহা
আশঙ্কা ছিল, যে কোনও দিন ডাক আসবে! তৃণমূল শিবিরে আতঙ্কের শিহরন ছড়িয়ে সেই ডাক এল সোমবার। এবং এ বার সিবিআইয়ের চেয়েও বেশি আতঙ্কের ঠান্ডা স্রোত বইয়ে দিলেন তলব পাওয়া খোদ মুকুল রায়ই!
সৃঞ্জয় বসু, মদন মিত্রের মতোই মুকুলকে তলব করার খবর পাওয়ার পরেও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব শোনাতে শুরু করে দেন তৃণমূল নেতারা। ‘ভয়ঙ্কর প্রতিহিংসার খেলা’ শুরু হয়েছে মন্তব্য করে সিবিআই-কে বিজেপি-র শাখা সংগঠন আখ্যা দেন। ডাক দেন চক্রান্তের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক মোকাবিলার। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক নিজে কিন্তু এ দিন সেই পথে হাঁটেননি। শুধু নিজেকে নির্দোষ দাবি করেই নিরস্ত থেকে জানিয়েছেন, সিবিআই যখনই বলবে, তখনই গিয়ে তাদের মুখোমুখি হতে তিনি তৈরি!
এমনিতেই মুকুলের ঘনঘন দিল্লি যাত্রা এবং সেখানে দীর্ঘ সময় কাটানো নিয়ে তৃণমূলের অন্দরে জল্পনা শুরু হয়েছিল। তার উপর তাঁর এ দিনের মন্তব্য দলীয় নেতাদের রক্তচাপ বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে কি মুকুলের মাথায় কোনও অভিসন্ধি ঘুরছে? তা হলে তিনিও কি মদনের মতো ভেবে রেখেছেন, ডুবলে ডালপালা নিয়েই ডুববেন? তা হলে কি মুকুল সিবিআইয়ের ঘরে ঢুকে এমন সুরে গাইবেন, যাতে তাদের হাত অবধারিত ভাবে পৌঁছে যাবে আরও বড় মাথার দিকে? দলের মধ্যে আতঙ্কের এই কাউন্ট ডাউনের স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েই মুকুলের ঘনিষ্ঠ সূত্র বলছে, “মুকুলদাকে সিবিআই ডেকে পাঠানোয় দাদার চেয়ে দিদি বেশি উদ্বিগ্ন!”
তৃণমূলের মধ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মানেই যে মুকুল এবং মুকুল মানেই যে প্রায় মমতা, এ আর জানতে বাকি নেই কারও। সারদা-কাণ্ডে সিবিআই তদন্ত শুরু হওয়ার পরে এই মুকুলই একাধিক বার তাঁর দলনেত্রীর সততা ও স্বচ্ছতার পক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন। দলের লাইনে সিবিআইয়ের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্তু সেই যে মমতার আমলে সারদার সঙ্গে আইআরসিটিসি-র চুক্তির কথা প্রকাশ্যে আসার সময় মুকুল বললেন ওই সময়ে তিনি রেলমন্ত্রী ছিলেন না, তখন থেকেই সুর কেমন যেন কেটে কেটে যাচ্ছে! দলে মুকুলের গুরুত্ব কমিয়ে ‘যুবরাজ’ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে তুলে এনেছেন মমতা। দলের নীতি নির্ধারণের বৈঠকেও ইদানীং দেখা যাচ্ছে না মুকুলকে। আর এ দিন সিবিআইয়ের সমন পাওয়ার পরে তৃণমূলের প্রিয় ‘চক্রান্ত’ শব্দটাই কি না বাদ পড়ে গেল তাঁর গলা থেকে? দলের মধ্যেই সভয় প্রশ্ন উঠছে, এ কি নেহাতই কাকতালীয়? বিশেষ করে এ নিয়ে প্রশ্নও যখন এ দিন এড়িয়ে গিয়েছেন মুকুল। তাঁর বক্তব্য, “আমি দলের মুখপাত্র নই। দল তাদের অবস্থান জানিয়েছে।” এমনকী, সারদায় সিবিআই-কে রাজনৈতিক ভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, এই অভিযোগে কাউকে দিয়ে শীর্ষ আদালতে মামলা করানো হবে এবং সেই মামলার কাগজপত্র তৈরি করতেই ইদানীং দিল্লিতে ব্যস্ত থাকছেন তিনি, এহেন জল্পনাও এ দিন ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছেন মুকুল।
মুকুল চক্রান্ত-তত্ত্ব এড়িয়ে গেলেও, দলের জাতীয় মুখপাত্র ডেরেক ও’ব্রায়েন কিন্তু যথারীতি বলেছেন, “বাংলায় লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি রাজনৈতিক ভাবে পরাজিত হয়েছিল। সেই জন্য পুরসভা নির্বাচনের কয়েক মাস আগে থেকে তারা এই নোংরা কৌশল নিয়েছে! ভয়ঙ্কর প্রতিহিংসার খেলা শুরু হয়েছে। সমন এসে পৌঁছনোর আগেই বিজেপি-র মুখপাত্রেরা বাইট দিতে শুরু করেছেন!” তাঁর আরও প্রশ্ন, “সিবিআই কি প্রধানমন্ত্রীর দফতরের নির্দেশেই চলছে? নাকি অমিত শাহের নির্দেশে?”
কলকাতায় দলের সদর দফতরে বসে তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় আবার মুকুলকে সিবিআই নোটিস পাঠানোর যাবতীয় দায় চাপিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের ভারপ্রাপ্ত বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতা সিদ্ধার্থনাথ সিংহের উপরে। তাঁর মন্তব্য, “সিদ্ধিনাথবাবু (সিদ্ধার্থনাথ) সিবিআইয়ের অ্যাডিশনাল ডিরেক্টর হয়ে গিয়েছেন! তিনি দিনক্ষণ ঠিক করে কাকে কখন ধরা হবে, বলে দিচ্ছেন!” একই সঙ্গে পার্থবাবুর হুঁশিয়ারি, “একটা মুকুল রায়কে নোটিস দিয়ে তৃণমূলকে শেষ করা যাবে না! ঘাস যেমন কাটলে বেড়ে যায়, তেমনই লক্ষ লক্ষ মুকুল প্রতিবাদ করবে!” কবে কোথায় কী ভাবে প্রতিবাদ শুরু হবে, তা অবশ্য এ দিন স্পষ্ট করেননি তৃণমূল নেতৃত্ব।
বিরোধীরা অবশ্য মুকুলের পথ ধরেই মমতা পর্যন্ত পৌঁছতে চাইছেন। কলকাতায় এসে সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য সীতারাম ইয়েচুরি বলেছেন, “তৃণমূল যেমনই হুমকি দিক, তদন্তকারীদের ভীত হলে চলবে না। ‘নম্বর টু’ যখন ডাক পেয়েছেন, এর পরে মুখ্যমন্ত্রীকেও জেরা করতে হবে।” সারদায় মামলাকারী কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নান বলেছেন, “যখন কেউ কারও নাম নিয়ে জল্পনা করছে না, তখন মুখ্যমন্ত্রীই পাঁচটা নাম বলে দিয়েছিলেন। কুণাল চোর, টুম্পাই (সাংসদ সৃঞ্জয় বসু) চোর, মদন চোর হতে হতে মুকুল পর্যন্ত ডাক পৌঁছেছে। এ বার তো আর এক জনেরই পালা!” সিদ্ধার্থনাথও কটাক্ষ করেন, “সিবিআই নিরপেক্ষ ভাবে তদন্ত করছে। সেই তদন্তের জাল মুকুল রায় পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে। এর পরে মুখ্যমন্ত্রীর চৌকাঠ পেরিয়ে তাঁর ঘরে ঢুকবে!”
বিরোধীরা যত কটাক্ষ করছেন, তৃণমূল শিবিরের চেহারা ততই যেন ফ্যাকাসে হচ্ছে! তৃণমূল ভবনে এ দিন পার্থবাবু ছাড়া আর গুটিকয়েক নেতা গিয়েছিলেন। অন্য দিনের তুলনায় লোকলস্কর বা গাড়ির বহর, সবই ছিল কম। সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হওয়ার আগে দলীয় নেতাদের সঙ্গে দ্রুত বৈঠক সেরে নেন পার্থবাবু। তার পরে দলের বক্তব্য লিখে নিয়ে ক্যামেরার সামনে আসেন তিনি। যা সচরাচর করতে দেখা যায় না পার্থবাবুকে!
তৃণমূল নেতা-কর্মীদের অনেককেই এ দিন দেখা গিয়েছে দলের ভবিষ্যৎ নিয়ে উৎকণ্ঠা নিয়ে চাপা স্বরে আলোচনা করতে। তৃণমূল ভবনের বাইরে দলীয় কর্মীদের আলোচনায় মন্তব্য শোনা গেল “ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্রে নেত্রী বলেছিলেন, কুণাল চোর, টুম্পাই চোর, মদন চোর...। সব তো একে একে ঢুকে যাচ্ছে! কী দরকার ছিল বলার?”
প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে নেতা-নেত্রীদের মধ্যেও। যার গোড়াতেই রয়েছে সারদা কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্তদের সমর্থনে পথে নামা নিয়ে। এক রাজ্য নেতা তো দলের অন্দরের আলোচনায় বলেই দিয়েছেন, “আমার একটা মানসম্মান আছে। চোর-ছ্যাঁচড়দের বাঁচাতে আমি অন্তত রাস্তায় নামতে পারব না!” সঙ্কটজনক পরিস্থিতিতে দলে ভাঙন ঠেকাতে হলে নতুন করে ভোটে যাওয়ার প্রস্তাবও উঠতে শুরু করেছে। নেতাদের কেউ কেউ শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে প্রস্তাব দিয়েছেন, সরকার ভেঙে দিয়ে, পুরভোটের সঙ্গেই বিধানসভার ভোটে যাওয়া উচিত মমতার। দলের এক প্রবীণ নেতার কথায়, “আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে বলে চিৎকার করে কোনও লাভ নেই! মানুষের রায় নেওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ।”
দলনেত্রী সেই পথেই হাঁটবেন কি না, দলের মধ্যে এখন থেকে সেই জল্পনা আরও বাড়বে। স্বয়ং মুকুল অবশ্য এখনই অতশত জল্পনায় যাচ্ছেন না। মদনের দীর্ঘ অসুস্থতা-পর্বের প্রতি প্রচ্ছন্ন খোঁচা দিয়ে তিনি বলছেন, “আমার কোনও তাপ-উত্তাপ নেই। আমি অসুস্থও নই! সিবিআই সময় বলে দিলে চলে যাব। আমার ভয়ের বা লুকোবার কিছু নেই!”
ঠিক সেটাই যে বেজায় ভয়ে রাখছে মমতার দলকে!