ছেলের সভার ভিড় দেখে আবেগে ভাসলেন বাবা

শিশুর মতো উচ্ছ্বাসে তারিফ করলেন বাবা। “ফাটিয়ে দিলি তো তুই। তুই তো দেখছি ৪০ দিনেই নেতা হয়ে গিয়েছিস।” তমলুকের কাকগেছিয়া মাঠে কপ্টারে উঠেই ছেলেকে বললেন সুনীলচন্দ্র বড়াল। কিছু ক্ষণ আগেই জীবনের প্রথম ‘একক’ রাজনৈতিক জনসভা শেষ করেছেন বড়ালবাবুর ছেলে। কিঞ্চিৎ লজ্জা পেয়ে বাবুল সুপ্রিয় বললেন, “কী যে বলো বাবা!”

Advertisement

জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ মে ২০১৪ ০২:৩৭
Share:

জয়নগরের বিজেপি প্রার্থী কৃষ্ণপদ মজুমদারের প্রচারে এলেন বাবুল সুপ্রিয়। শনিবার বহড়ু হাইস্কুলের মাঠে। ছবি: শশাঙ্ক মণ্ডল

শিশুর মতো উচ্ছ্বাসে তারিফ করলেন বাবা।

Advertisement

“ফাটিয়ে দিলি তো তুই। তুই তো দেখছি ৪০ দিনেই নেতা হয়ে গিয়েছিস।” তমলুকের কাকগেছিয়া মাঠে কপ্টারে উঠেই ছেলেকে বললেন সুনীলচন্দ্র বড়াল। কিছু ক্ষণ আগেই জীবনের প্রথম ‘একক’ রাজনৈতিক জনসভা শেষ করেছেন বড়ালবাবুর ছেলে। কিঞ্চিৎ লজ্জা পেয়ে বাবুল সুপ্রিয় বললেন, “কী যে বলো বাবা!” পর ক্ষণেই আবার, “কী অমলদা (অমলেন্দু চট্টোপাধ্যায়, রাজ্য বিজেপির সংগঠন সম্পাদক) কেমন হল? সত্যি বলুন। বাবার কথা বাদ দিন। উতরে গেলাম কি না?” অমলবাবু বললেন, “তোমার প্রতিটি কথার মাঝে হাততালি পেয়েও বুঝতে পারলে না? পাবলিক তোমায় নিচ্ছে, সত্যিই নিচ্ছে।” তত ক্ষণে বনবন ডানা ঘুরিয়ে চপার মাটি ছেড়েছে। পাইলট বললেন, “স্যর, মুভিং ফর ঘাটাল।”

পাবলিক নিচ্ছে বলেই পঞ্চম দফা ভোটের প্রচারের শেষ দিনে বাবুলের জন্য একটি আস্ত হেলিকপ্টার বরাদ্দ করেছিল রাজ্য বিজেপি। নরেন্দ্র মোদী কলকাতায় শেষ সভা করে গিয়েছেন গত বুধবার। তার পর প্রচারের শেষ দিনের পদ্ম-ঝড় তুলতে বাবুলের জন্য এক দিনে সাতটি সভার বন্দোবস্ত। প্রায় কাকভোরে তমলুক দিয়ে শুরু।

Advertisement

যার শেষ হল বসিরহাটে। মাঝে সুন্দরবনের বেশ কয়েকটি প্রত্যন্ত এলাকা, যেখানে বাংলাদেশ টেলিফোনের স্বাগত বার্তা বার বার ফুটে উঠেছে সেলফোনের স্ক্রিনে।

বাবুলের বাবাই বার বার তা খেয়াল করে দেখাচ্ছিলেন ছেলেকে। আর বলছিলেন, “দ্যাখ, কোথায় এসে গেছি আমরা।” গত ৪০ দিনে বাবুল ঠিক কোথায় এসে পড়েছেন, তা নিয়ে এখনও তাঁর নিজের বিস্ময়ও কাটেনি। তাঁর অবস্থান এখন কোথায়, তা দেখাতে ১৫ মে মুম্বই থেকে মেয়ে শর্মিলিকে আসানসোল উড়িয়ে এনে তা দেখাতে চান গায়ক-নেতা। গণনার দিনটা মেয়ের সঙ্গেই উপভোগ করতে চান তিনি।

ঠিক যেমন প্রচারের শেষ দিনটা উপভোগ করলেন বাবার সঙ্গে। বাবুল বললেন, “শুনলাম কপ্টারের একটি আসন খালি রয়েছে। তখনই ঠিক করলাম বাবা তো কোনও দিন হেলো-তে চড়েনি। শনিবার বরং সারা দিন বাবার সঙ্গে কপ্টারেই কাটাব। কী বাবা, ভাল লাগছে তো?” সুনীলবাবু তখন গোল গোল চোখে নীচের দিকে তাকিয়ে বলছেন, “এটাই মনে হয় শীলাবতী নদী। উরিব্বাস, কত লোক ছুটে আসছে। ঘাটাল চলে এলাম মনে হয়।” বাবুল দু’হাত চালিয়ে চুল ঠিক করে নিলেন। রিডিং গ্লাস বদলে

উঠল সানগ্লাস। ‘স্টার ক্যাম্পেনারের’ প্রশ্ন, “অমলদা, এটা তো দেবের কেন্দ্র?” এই ভোটে বিজেপি-র অন্যতম ‘স্ট্র্যাটেজিস্ট’-এর জবাব,“হ্যাঁ, সারদাটা ভুলবে না। নট্ট কোম্পানিতে হাততালি পাচ্ছ। শিক্ষিত এলাকা,

টেট-টাও মেনশন করবে। দেব নিয়ে বলবে, ওঁর ছবি দেখুন, কিন্তু ভোট দিন মোদীকে।”

হেলিপ্যাডে থিকথিকে ভিড় দেখে অবাক বাবুল। “বাপ রে এত লোক।” অমলদার টিপস মেনে বাবুল তুললেন নট্ট কোম্পানির কথা। বললেন, “জানেন, নট্ট কোম্পানি পর পর দু’টো যাত্রা করেছিল। প্রথমটা ছিল মা-মাটি-মানুষ। আর দ্বিতীয়টা কী জানেন?” জনতা একের পর এক নাম বলছে। গায়ক-নেতা বললেন, “না, না, না। আরে দ্বিতীয়টা ছিল অচল পয়সা।” হাততালি আর থামে না। ভাষণ তো থামল। কিন্তু ২০০ মিটার দূরত্বে হেলিপ্যাডে পৌঁছতে গিয়ে বেশ কাহিল হলেন তিনি। সবার দাবি, গান গাইতে হবে আর সই দিতে হবে। যত দূর পারলেন, মানলেন সেই আবদার।

কিন্তু বাবুল বোধ হয় তখনও বুঝতে পারেননি তাঁর জন্য আরও কী আবদার অপেক্ষা করছে। ঘাটালের পরে গন্তব্য মথুরাপুর। সুনীলবাবু চপারে উঠেই বললেন, “বাবুল, একটা হেলিকপ্টার কিনলে হয় না? এই টুক করে পুরী-দার্জিলিংটা তো ঘুরে আসা যাবে।” চমকে উঠলেন বাবুল। “ধুর, ধুর। তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? তবে বিলাসবহুল একটা গাড়ির চেয়ে হেলিকপ্টার কিন্তু খুব দামি নয়”, চপারের বাকি যাত্রীদের সাধারণ জ্ঞান বাড়ানোর তথ্য দিলেন তিনি। সমর্থন মিলল পাইলটের। এর মধ্যেই একটা ছোট্ট বিপদ থেকে বাঁচা গিয়েছে। ওই ২৩ বছরের অভিজ্ঞ পাইলটের দৌলতেই। মথুরাপুরে হেলিপ্যাডটি এতই ছোট ছিল যে সেখানে নামতে গিয়ে কপ্টারের ডানা বেড়ার বাঁশে ধাক্কা লাগার উপক্রম হয়েছিল। পাইলটের চোখ তা ধরে ফেলায় কোনও ক্রমে বিপদ এড়ানো গিয়েছে। সভাস্থলে জমা হওয়া হাজার দু’য়েক শ্রোতার তাই আর শোনা হল না ‘কহো না প্যার হ্যায়’-এর দু’কলি। যা বাবুলের কথায় পেঁয়াজিতে পেঁয়াজের মতোই।

মথুরাপুরে নামা হল না, তাই জয়নগরে আগেই পৌঁছে যেতে হল। শহরের মধ্যেই একটি স্কুল মাঠ ভর্তি হয়ে গিয়েছে। মহিলাদের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। এখানে অবশ্য গায়ক বাবুল, ‘বাবা বাবুল’-এ পরিণত হলেন। কারণ, অনেকেই মঞ্চে উঠে এসে ঢিপ ঢিপ করে প্রণাম করতে শুরু করেছেন। চরম অস্বস্তি। আর তখনই বোমাটা ফাটালেন সুনীলবাবু। “জানেন তো বাবুলকে রাজনীতির ময়দানে কে এনেছেন?” জানতে চাইলাম, “কে?” জানলামও। “বাবা রামদেব। এক দিন একই প্লেনে যাওয়ার সূত্রে রামদেবজী প্রস্তাবটা দেন। তার পর উনিই বিজেপির টপ লিডারদের জানিয়ে দেন বাবুল ফাইট করবে।”

ফাইট যে বাবুল করেছেন তার প্রমাণ আসানসোল। নরেন্দ্র মোদীরও তাঁকে পছন্দ হয়ে গিয়েছে। মিনাখাঁ সেরে তত ক্ষণে শেষ সভা বসিরহাটের সবুজ সঙ্ঘের মাঠ। ভিড়ে ঠাসা। সেখানকার প্রার্থী শমীক ভট্টাচার্য ভাষণে বলছেন, “আপনারা আমায় ভোট দিন বা না দিন দেশের প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন কিন্তু নরেন্দ্র মোদী। ফলে ভেবে সিদ্ধান্ত নিন।” শমীকের ভাষণ শুনে হাসি খেলে যাচ্ছে বাবুলের ঠোঁটে। ‘প্রধানমন্ত্রী’ মোদীই তো আসানসোলে তাঁকে দেশের হিরো বানানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে গিয়েছেন। সত্যিই কি তা হলে বাবুলের ‘‘আচ্ছে দিন আনেওয়ালা হ্যায়?”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন