হাওড়া স্টেশনে শাহনুর আলম। —নিজস্ব চিত্র।
পশ্চিমবঙ্গে তৈরি বিস্ফোরক ও আইইডি (ইম্প্রোভাইজ্ড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) দিয়েই ভারতে প্রথম নাশকতা ঘটানোর ছক ছিল জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি)-এর। ইনটেলিজেন্স ব্যুরো (আইবি) ও অসম পুলিশের দাবি, নতুন বছরের গোড়াতেই সেই হামলা হওয়ার কথা ছিল অসমে। বিশেষ করে, বড়ো স্বশাসিত পরিষদ এলাকায় ধারাবাহিক গ্রেনেড হামলার পরিকল্পনা করেছিল জেএমবি।
গোয়েন্দাদের বক্তব্য, ২০০৫-এর ১৭ অগস্ট বাংলাদেশের ৩০০টি জায়গায় হওয়া ৪৬০টি বিস্ফোরণের কায়দাতেই এই নাশকতার ছক কষা হয়েছিল। কিন্তু খাগড়াগড় বিস্ফোরণে দু’জনের নিহত হওয়া ও সেই সূত্রে জঙ্গি চক্র ফাঁস হয়ে যাওয়ায় গোটা পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। আইবি এবং পুলিশের একটি সূত্রের খবর, অসমে জেএমবি-র চাঁই শাহনুর আলম ও তার কয়েক জন শাগরেদকে জেরা করে এই তথ্য মিলেছে। গোয়েন্দাদের দাবি, কোকরাঝাড়, চিরাং-সহ কিছু জেলার বড়ো প্রভাবিত এলাকায় ধারাবাহিক নাশকতার ছক করেছিল জেএমবি। এর পরে নিশানা করা হতো পশ্চিমবঙ্গ-সহ আরও কয়েকটি রাজ্যকে।
খাগড়াগড় বিস্ফোরণের পর ঘটনাস্থল থেকে ৫৫টি দেশি গ্রেনেড উদ্ধার হয়। তার সপ্তাহ দুয়েক পরে বর্ধমানেরই বাদশাহি রোডের অন্য একটি জঙ্গি ডেরা থেকে এনআইএ-র গোয়েন্দারা এনএসজি-র সহযোগিতায় উদ্ধার করেন একই ধরনের আরও ৩৬টি গ্রেনেড।
এনআইএ-র দাবি, খাগড়াগড়ে বিস্ফোরক, আইইডি ও রকেট লঞ্চার তৈরির গবেষণাগারে শাহনুর একাধিক বার এসেছে। তা ছাড়া, বর্ধমানের শিমুলিয়া ও মুর্শিদাবাদের মকিমনগর মাদ্রাসার মতো জেহাদি প্রশিক্ষণের কেন্দ্রগুলিতে ও নদিয়া জেলার কয়েকটি জায়গায় সে এসেছিল। গত বছর ২ অক্টোবর দুপুরে খাগড়াগড়ে বিস্ফোরণ হয়। তার কিছু দিন আগেই খাগড়াগড়-সহ এ রাজ্যের বিভিন্ন জঙ্গি ডেরায় ঘুরে গিয়েছিল শাহনুর এবং তার দুই শাগরেদ সাইখুল ইসলাম ও রফিকুল ইসলাম। অসম থেকে এনে শনিবার ওই তিন জনকে কলকাতার নগর দায়রা আদালতে হাজির করানো হয়। বিচারক গোপালচন্দ্র কর্মকার তাদের ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত এনআইএ হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন। শাহনুর-সহ ওই তিন জনকে অসমের বিভিন্ন জায়গা থেকে গ্রেফতার করেছিল সে রাজ্যের পুলিশ। এনআইএ তাদের এ-ই প্রথম নিজেদের হেফাজতে পেল।
গোয়েন্দাদের দাবি, জেরায় শাহনুর ও জেএমবি-র অন্য ধৃত চাঁইরা জানিয়েছে, খাগড়াগড় ও বাদশাহি রোডে যে ধরনের গ্রেনেড উদ্ধার করা হয়, তেমন বোমা দিয়েই অসমে ধারাবাহিক বিস্ফোরণ ঘটানোর পরিকল্পনা ছিল। বরপেটার হাতুড়ে ডাক্তার শাহনুরকে গ্রেফতার করার কিছু দিনের মধ্যেই অসম পুলিশ জানায়, খাগড়াগড়ে তৈরি হওয়া কিছু আইইডি অসমে মজুত করা হয়েছে। এখনও সেগুলি উদ্ধার করা যায়নি।
শাহনুর, সাইখুল ও রফিকুলকে নিয়ে সরাইঘাট এক্সপ্রেসে শনিবার ভোরে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছন অসম পুলিশ ও এনআইএ-র গোয়েন্দারা। স্টেশন থেকে থেকে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় সল্টলেকের সেক্টর ফাইভে এনআইএ-এর অস্থায়ী অফিসে। বেলা ১১টা নাগাদ তাঁদের নগর দায়রা আদালতে নিয়ে আসা হয়।
শাহনুরদের হেফাজতে পাওয়ার পাশাপাশি ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের সন্দেহভাজন লিঙ্কম্যান জাহিদ হোসেনকে জেলের মধ্যে জেরা করতে চেয়ে এ দিন আদালতে আবেদন জানায় এনআইএ। পুলিশ সূত্রের খবর, জাহিদ বর্তমানে প্রেসিডেন্সি জেলে বন্দি। আদালত জানিয়ে দিয়েছে, জেলে গিয়ে এনআইএ জাহিদকে জেরা করতে পারবে। আদালতে এনআইএ-র আইনজীবী শ্যামল ঘোষ জানান, গত বছর ২ জুলাই রাতে কলকাতা স্টেশন থেকে কলকাতা পুলিশের স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ) বাংলাদেশি নাগরিক জাহিদকে গ্রেফতার করে।
বাংলাদেশ থেকে এই জাহিদই ২০০৯ সালে ১৫ কেজি বিস্ফোরক পাঠায় ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের তদানীন্তন ‘অপারেশনাল চিফ’ ইয়াসিন ভটকলকে। নদিয়ার আনোয়ার হোসেন মল্লিক সেই বিস্ফোরক সায়েন্স সিটি-র কাছে এক জায়গায় ইয়াসিনের হাতে তুলে দেয়। এনআইএ-র দাবি, ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের যে সব লোকজন বাংলাদেশে রয়েছে, তাদের হয়ে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় অস্ত্র ও বিস্ফোরক সরবরাহ করত জাহিদ। তাকে জেরা করে খাগড়াগড় কাণ্ডের কিছু ‘মিসিং লিঙ্ক’-এর সন্ধান পাওয়া যাবে বলে গোয়েন্দাদের আশা।
এ দিন খাগড়াগড় কাণ্ডে ধৃত দুই মহিলা-সহ অন্য সাত জনকেও আদালতে হাজির করানো হয়। তাদের আগামী ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত জেলে রাখার নির্দেশ দিয়েছে আদালত।
অন্তঃসত্ত্বা আলিমা, চিকিৎসার নির্দেশ আদালতের
খাগড়াগড়-কাণ্ডে ধৃত আলিমা বিবি চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা। তাঁর সব রকম চিকিৎসার নির্দেশ দিল কলকাতার নগর দায়রা আদালত। খাগড়াগড় কাণ্ডে অভিযুক্ত মোট ১০ জনকে শনিবার আদালতে হাজির করানো হয়। তাদের মধ্যে ছিল আলিমাও। আদালতে আলিমার আইনজীবী জানান, তাঁর মক্কেল চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা। তাঁর যথাযথ চিকিৎসা প্রয়োজন। এই আর্জির প্রেক্ষিতে বিচারক গোপালচন্দ্র কর্মকার আলিপুর মহিলা সংশোধনাগার কর্তৃপক্ষকে আলিমার যথাযথ চিকিৎসার জন্য নির্দেশ দেন। বস্তুত, খাগড়াগড়-কাণ্ডের মাস খানেক আগেই আলিমা গর্ভবতী হয়ে পড়েন। আলিমার আইনজীবী এটাও জানান, আলিমা তার স্বামীর সঙ্গে কথা বলতে চায়। আলিমার সেই আর্জিও মঞ্জুর করেন বিচারক। আলিমার স্বামী আব্দুল হাকিম খাগড়াগড় কাণ্ডের আর এক অভিযুক্ত। হাকিম ওই বিস্ফোরণের একমাত্র জীবিত প্রত্যক্ষদর্শী। আদালত কক্ষের মধ্যেই আলিমা ও তাঁর স্বামী আব্দুল হাকিম কথা বলে। স্ত্রী-র কোল থেকে মেয়েকে কোলেও নেয় হাকিম। খাগড়াগড়ের আর এক অভিযুক্ত, মালদহের বাসিন্দা জিয়াউল হকের কাল, সোমবার বিএড পরীক্ষা শুরু হচ্ছে। জিয়াউলকে পরীক্ষার সরঞ্জাম দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে আদালত।