সুপ্রিম কোর্টে বন্ধু সিব্বল

জোটের ইঙ্গিতে লাভ কিন্তু বিজেপিরই

আপাতদৃষ্টিতে একটি সামান্য পদক্ষেপ। যা যে কোনও আইনজীবীই করতে পারেন। কিন্তু সারদা-বিধ্বস্ত বাংলার রাজনীতিতে সেই আপাত-সামান্য পদক্ষেপই অন্য রকম সমীকরণের ইঙ্গিত বয়ে আনল! সারদা-কাণ্ডে সুপ্রিম কোর্টের নজরদারিতে সিবিআই তদন্তের আর্জি জানিয়ে তৃণমূলের সরকারের দায়ের করা মামলায় আইনজীবী হিসাবে সওয়াল করছেন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী তথা কংগ্রেস নেতা কপিল সিব্বল! সারদা কেলেঙ্কারিতে রাজ্যে তৃণমূল যখন কোণঠাসা এবং মুখ্যমন্ত্রীর ইস্তফা চেয়ে দেরিতে হলেও প্রদেশ কংগ্রেস পথে নেমেছে, তখন সিব্বলের এমন সিদ্ধান্তে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি সনিয়া গাঁধীর প্রচ্ছন্ন বার্তাই দেখতে পাচ্ছেন অনেকে! তৃণমূলের এক নেতার কথায়, “বিয়ে এখনও পাকা হয়নি ঠিকই। তবে কথাবার্তা শুরু হয়ে গেল!”

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা ও নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২০ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:১৭
Share:

আপাতদৃষ্টিতে একটি সামান্য পদক্ষেপ। যা যে কোনও আইনজীবীই করতে পারেন। কিন্তু সারদা-বিধ্বস্ত বাংলার রাজনীতিতে সেই আপাত-সামান্য পদক্ষেপই অন্য রকম সমীকরণের ইঙ্গিত বয়ে আনল!

Advertisement

সারদা-কাণ্ডে সুপ্রিম কোর্টের নজরদারিতে সিবিআই তদন্তের আর্জি জানিয়ে তৃণমূলের সরকারের দায়ের করা মামলায় আইনজীবী হিসাবে সওয়াল করছেন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী তথা কংগ্রেস নেতা কপিল সিব্বল! সারদা কেলেঙ্কারিতে রাজ্যে তৃণমূল যখন কোণঠাসা এবং মুখ্যমন্ত্রীর ইস্তফা চেয়ে দেরিতে হলেও প্রদেশ কংগ্রেস পথে নেমেছে, তখন সিব্বলের এমন সিদ্ধান্তে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি সনিয়া গাঁধীর প্রচ্ছন্ন বার্তাই দেখতে পাচ্ছেন অনেকে! তৃণমূলের এক নেতার কথায়, “বিয়ে এখনও পাকা হয়নি ঠিকই। তবে কথাবার্তা শুরু হয়ে গেল!”

দুর্নীতি-সহ একের পর অভিযোগে জেরবার তৃণমূল এখন বন্ধুহীন। সেই সময়ে পুরভোটের আগেই কংগ্রেস হাইকম্যান্ড যদি বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয়, তা অবশ্যই তাদের কাছে সুখবর। কিন্তু তার থেকেও বড় সুখবর সম্ভবত বিজেপির। কারণ, এর ফলে যাবতীয় বিশ্বাসযোগ্যতা খুইয়ে এর পর কংগ্রেসের ভোটব্যাঙ্ক বিজেপির দিকে পাড়ি দেবে, এমন সম্ভাবনাই প্রকট হল। তৃণমূল-বিরোধী ভোট ভাগাভাগি কমে গিয়ে ২০১৬-র বিধানসভা ভোটে মমতা-বিরোধী হাওয়ার ফায়দা তুলতে পারবে তারা। আজ, মঙ্গলবার বর্ধমানে সভা করতে আসার আগে এমন অযাচিত প্রাপ্তিতে তৃপ্ত বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহের মন্তব্য, “এ তো মেঘ না-চাইতেই জল!”

Advertisement

সিব্বলের মামলা লড়ার সিদ্ধান্তই যে যাবতীয় জল্পনার জন্ম দিচ্ছে, বিষয়টি অবশ্য এমন নয়। আসলে তৃণমূলের প্রতি কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বার্তা বেরিয়ে আসছে তাঁদের ধারাবাহিক মনোভাব থেকেই। সারদা কেলেঙ্কারিতে সিবিআই তদন্ত চেয়ে জনস্বার্থের মামলা করার জন্য এ রাজ্যের কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নান যখন ছোটাছুটি করছেন, তখন অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি বা সিব্বলেরা কিন্তু আদালতে তাঁর হয়ে সওয়াল করতে যাননি। সে যাত্রা মান্নানকে উদ্ধার করেছিল সিপিএম। তাঁর হয়ে বিনা পয়সায় মামলা লড়েন কলকাতার প্রাক্তন মেয়র বিকাশ ভট্টাচার্য। আর এখন সেই তদন্তের জালে যখন তৃণমূলের একের পর এক রাঘব বোয়াল জড়িয়ে যাচ্ছেন, তখন রাজ্যের হয়ে দাঁড়াচ্ছেন সিব্বল।

কেন? তার ব্যাখ্যা দিয়ে এ দিন মুখ খোলেননি সিব্বল নিজে। ফোন ধরেননি। এসএমএসেরও জবাব দেননি। কিন্তু কংগ্রেস সূত্রের খবর, সনিয়া গাঁধীর রাজনৈতিক সচিব আহমেদ পটেলের সবুজ সঙ্কেত নিয়েই এগিয়েছেন তিনি। এমনকী, সওয়াল শেষে তৃণমূল নেত্রী মহুয়া মৈত্রের ফোন থেকে কথা বলেছেন খোদ মমতার সঙ্গে। আশ্বাস দিয়েছেন, প্রয়োজন হলে এমনকী নিম্ন আদালতেও সারদা মামলা লড়ার ব্যাপারে আইনি পরামর্শ দেবেন তিনি।

এই পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক ভাবেই বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের তরফে এ রাজ্যের দায়িত্বপ্রাপ্ত সিদ্ধার্থনাথ সিংহ প্রশ্ন তুলেছেন, “সনিয়া এবং রাহুল গাঁধীর কাছে জানতে চাইছি, তাঁদের যে নেতার জন্য সিবিআই তদন্তের নির্দেশ জারি হল, তাঁকে (মান্নান) কি তাঁরা পরিত্যাগ করেছেন? যদি না করে থাকেন, তা হলে কি সিব্বলকে সাসপেন্ড করে প্রমাণ দেবেন যে, কংগ্রেস সত্যিই দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়তে চায়?”

সিব্বলের সওয়ালের সিদ্ধান্তে ফুঁসছে আম-ছালা দুই-ই খোয়ানো প্রদেশ কংগ্রেস। মঙ্গলবার শহিদ মিনার ময়দানে রাজ্য সরকারের দুর্নীতি ও অপশাসনের প্রতিবাদে সমাবেশের ডাক দিয়েছিল তারা। তার আগে এই ঘটনা সেই সমাবেশে কার্যত ঠান্ডা জল ঢেলে দিল। ক্ষুব্ধ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর প্রতিক্রিয়া, “সারদার মতো ঘটনায় এ রাজ্যের সরকারের হয়ে ওকালতি করা ঠিক হয়নি। উকিলের কাজ ওকালতি করা। কিন্তু সিব্বলের মতো পরিচিত মুখের কাছে দলের থেকে পেশা বড় হতে পারে না!” তিনি প্রদেশ সভাপতি থাকাকালীন এ রাজ্যে দলের কোনও অনুষ্ঠানে সিব্বলকে আমন্ত্রণ জানাবেন না বলেও ঘোষণা করেছেন অধীর।

সিব্বলের কাজে যে বিজেপি-ই অস্ত্র পেয়ে গেল, তা মেনে নিচ্ছেন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী দীপা দাশমুন্সিও। মান্নানের পাশে দাঁড়িয়ে দীপা এ দিন বলেছেন, “বিজেপি-কে এ সব বলার সুযোগ তো করে দেওয়া হল! তারা সহজেই বলতে পারবে, কংগ্রেস-তৃণমূল আবার জোট হবে! অথচ গোটা রাজ্যের ভুক্তভোগী মানুষ এখন তৃণমূলের শাসনের অবসান চাইছেন!” সিব্বলের সঙ্গে তৃণমূল যোগাযোগ করছে জেনেই তাঁকে আটকানোর জন্য ১০ জনপথের কাছে আর্জি জানিয়েছিলেন দীপা। কিন্তু তাতে যে কোনও কাজ হয়নি, বোঝাই যাচ্ছে! কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য নেতৃত্বের প্রতি ক্ষোভে মান্নানের মতোই আজ শহিদ মিনারের সমাবেশে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দীপা। এ দিন প্রদেশ কংগ্রেস দফতরের সামনে বিক্ষোভ হয়েছে দক্ষিণ কলকাতা জেলা কংগ্রেসের সভানেত্রী মালা রায়ের নেতৃত্বে। ‘তৃণমূলের দালালি’ করার অভিযোগ এনে সিব্বলকে দল থেকে বহিষ্কারের দাবি তুলেছেন বিক্ষোভকারীরা। আবার সিব্বল যাতে শেষ পর্যন্ত ওই মামলা না লড়েন, সেই আবেদন জানিয়ে সনিয়া, রাহুল এবং জোশীকে চিঠি দিয়েছেন সোমেন মিত্র।

কংগ্রেসের আর এক আইনজীবী-নেতা অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি বলেছেন, “জোটের জল্পনা ভিত্তিহীন। এ ব্যাপারে দলে আলোচনা হয়নি!” কংগ্রেস নেতাদের অনেকেই জানাচ্ছেন, বিজেপি-কে ঠেকাতে সব ধর্মনিরপেক্ষ দলের সঙ্গে সমঝোতা করতে তাঁরা প্রস্তুত। জওহরলাল নেহরুর ১২৫তম জন্মবার্ষিকী সম্মেলনে তৃণমূল নেত্রীকে আমন্ত্রণ জানিয়ে সনিয়া সেই বার্তাও দিয়েছেন। কংগ্রেস নেতাদের বক্তব্য, মমতা যে ভাষায়, যে উগ্রতার সঙ্গে নরেন্দ্র মোদীকে আক্রমণ করতে পারেন, সেটা কোনও কংগ্রেস নেতার পক্ষে করা সম্ভব নয়। কিন্তু মমতার পাশে থাকলে সেই আক্রমণের সুফল পাওয়া যাবে।

লাভের হিসেব কষছে তৃণমূলও। দলের সাংসদের কথায়, “আমাদের দল মূল নিশানা করেছে সংখ্যালঘু ভোটকে। সেই ভোট ভাগ হয়ে আছে কংগ্রেস, বাম এবং আমাদের মধ্যে। কংগ্রেস আমাদের দিকে চলে এলে সংখ্যালঘু ভোটের সিংহভাগই নিশ্চিত করা যাবে।” আর তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্য, “ভাল! যা বলার, সময় মতো বলব!”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন