জেহাদের বীজ বুনতে নজরে দম্পতিরা

তিন দিনের পাঠ্যক্রম। শিক্ষার্থীর আসনে অল্পবয়সী দম্পতিরা। শিক্ষাশেষে যারা কিনা রীতিমতো উজ্জীবিত হয়ে উঠবে জেহাদের আদর্শে! এবং সহজেই জড়িয়ে পড়বে জঙ্গি-জালে। খাগড়াগড়-বিস্ফোরণের তদন্তে সন্ত্রাস-চক্রান্তের এমন একটা ছবিও গোয়েন্দাদের সামনে ফুটে উঠছে। তাঁদের দাবি, শিমুলিয়ার মতো বর্ধমান-বীরভূম-মুর্শিদাবাদ জেলার বেশ কিছু কয়েকটি ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মূলত বাছাই করা দম্পতিদের নিয়ে এই জাতীয় জেহাদি প্রশিক্ষণের ‘ক্র্যাশ কোর্স’ চলত।

Advertisement

শিবাজী দে সরকার ও কুন্তক চট্টোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০১৪ ০২:৪৫
Share:

তিন দিনের পাঠ্যক্রম। শিক্ষার্থীর আসনে অল্পবয়সী দম্পতিরা। শিক্ষাশেষে যারা কিনা রীতিমতো উজ্জীবিত হয়ে উঠবে জেহাদের আদর্শে! এবং সহজেই জড়িয়ে পড়বে জঙ্গি-জালে।

Advertisement

খাগড়াগড়-বিস্ফোরণের তদন্তে সন্ত্রাস-চক্রান্তের এমন একটা ছবিও গোয়েন্দাদের সামনে ফুটে উঠছে। তাঁদের দাবি, শিমুলিয়ার মতো বর্ধমান-বীরভূম-মুর্শিদাবাদ জেলার বেশ কিছু কয়েকটি ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মূলত বাছাই করা দম্পতিদের নিয়ে এই জাতীয় জেহাদি প্রশিক্ষণের ‘ক্র্যাশ কোর্স’ চলত। গরমের ছুটি বা অন্য কোনও উৎসবের লম্বা ছুটি চলাকালীন, যাতে নিয়মিত পড়ুয়াদের চোখ এড়ানো যায়।

এ দেশে জেএমবি’র মাথা যারা, সেই সাজিদ-ইউসুফেরা পশ্চিমবঙ্গে জঙ্গি মডিউল পত্তনের জন্য অবিবাহিত ছেলে-মেয়েদের চেয়ে তরুণ দম্পতিদেরই বেশি গুরুত্ব দিত বলে এনআইএ-সূত্রের দাবি। তদন্তকারীদের ব্যাখ্যা: স্বামী-স্ত্রী দু’জনকেই জেহাদি তালিম দিয়ে গোটা পরিবারকে নিজেদের কব্জায় আনাই ছিল চক্রীদের লক্ষ্য। উপরন্তু পরিবার থাকলে বাড়ি ভাড়া পাওয়াটা সহজ। এক গোয়েন্দার কথায়, “স্বামী বিপথে গেলে অনেক স্ত্রী মেনে নিতে পারে না। সে ক্ষেত্রে জেহাদি হয়েও পারিবারিক বাধায় স্বামী লক্ষ্যচ্যুত হতে পারে। পাশাপাশি অবিবাহিত যুবকের পক্ষে অচেনা জায়গায় একা থাকা অসুবিধে।”

Advertisement

এই সব কারণে দম্পতিদের দিকে বেশি নজর দিয়েছিল সাজিদ-ইউসুফেরা। সংগঠনে নাম লেখানো এমন কিছু দম্পতিকে একজোট করে মাদ্রাসায় এনে রাখা হতো তিন দিন, জঙ্গিপনায় হাতেখড়ি দিতে। মেয়েরা যাতে স্বচ্ছন্দ বোধ করে, সে জন্য থাকত মহিলা প্রশিক্ষকেরাও। তিন দিনের ‘কোর্সে’ ধর্মশিক্ষা, শাস্ত্র আলোচনার সঙ্গে সমান তালে চলত শারীরিক কসরত ও অস্ত্রচালনার প্রাথমিক তালিম। কী রকম?

গোয়েন্দাদের দাবি, ধৃতদের জেরা করে তা-ও জানা গিয়েছে। প্রতি দিন ভোরে প্রার্থনা শেষে শারীরিক কসরতের ক্লাস পুরুষদের এক ঘণ্টা, মেয়েদের আধ ঘণ্টা। তার পরে ধর্মীয় শিক্ষা। দুপুরে খেয়ে-দেয়ে খানিক বিশ্রাম। বিকেলে জেহাদি বক্তৃতার পালা। ছাত্রেরা সামনে বসে শুনত, ছাত্রীরা পর্দার আড়ালে বসে। তার পরে এয়ার গান দিয়ে চাঁদমারির সেশন। অন্ধকার নামলে ফের প্রার্থনা, রাতের খাওয়া, ঘুম।

তিন দিন এ হেন রুটিন মেনে চলার পরে শিক্ষার্থী এক-একটি পরিবার জেহাদি ভাবধারায় পুরোদস্তুর দীক্ষিত হয়ে বেরিয়ে আসত। যাওয়ার আগে প্রশিক্ষকেরা বুঝিয়ে দিত, পাড়াপড়শি ও পুলিশের নজর এড়িয়ে নিজের এলাকায় কী ভাবে কাজ করতে হবে।

বস্তুত বর্ধমান-কাণ্ডের তদন্ত-সূত্রে একের পর এক নারী চরিত্রের হদিস মিলছে। প্রত্যেকেই কোনও না কোনও জঙ্গির স্ত্রী, এবং প্রত্যেকেই পাকাপোক্ত জঙ্গি মানসিকতায় গড়ে ওঠা। খাগড়াগড়ের বাড়িতে বিস্ফোরণের পরে আলিমা বিবি-রাজিয়া বিবিরা রিভলভার উঁচিয়ে মানুষকে হুমকি দিয়েছে। তখন কিন্তু এক জনের স্বামীর দেহ ছিন্নভিন্ন, আর এক জনের স্বামী পড়ে কাতরাচ্ছে! সেই পরিস্থিতিতেও দুই যুবতী এতটুকু ভেঙে পড়েনি, যা দেখে পুলিশও অবাক। আলিমা-রাজিয়াকে জেরা করতে গিয়েও গোয়েন্দাদের ঘাম ছুটেছে। অসমের বরপেটার হাতুড়ে ডাক্তার শাহনুর আলমের স্ত্রী সুজানাও তা-ই। তাকেও গ্রেফতার করা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, শাহনুর-সুজানা কিংবা হাকিম-আলিমার মতো অনেকে মাদ্রাসায় এসে বিয়ে করেছিল। “হতে পারে, জেহাদের পাশাপাশি সংগঠনের সদস্যদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনে চক্রীরাই উৎসাহ দিত।” মন্তব্য এক গোয়েন্দার। ওঁদের অনেকে মহিলাদের জঙ্গি বানানোর পিছনে আরও একটা কারণ দেখতে পাচ্ছেন। ওঁরা বলছেন, এ রাজ্যে মহিলা জঙ্গি এখনও সে ভাবে নজরে আসেনি। ফলে প্রমীলা বাহিনীকে কাজে লাগিয়ে বিস্ফোরক পাচার-সহ অনেক কাজ সহজে করানোর পরিকল্পনা ছিল। মেয়েদের উজ্জীবিত করার ভার মেয়েরাই নিত।

যে কারণে বরপেটার সুজানা শিমুলিয়ায় এসে প্রশিক্ষকের ভূমিকা পালন করে গিয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন