টিএমসিপির হামলা, নেত্রীকে ঘেরাওয়ের হুমকি এবিভিপির

যত সময় যাচ্ছে, রাজ্যের ছাত্র রাজনীতিতে প্রধান বিরোধী শক্তি হিসেবে উঠে আসছে অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ (এবিভিপি)। আর, জমি হারানোর আতঙ্কে মারমুখী হয়ে উঠছে টিএমসিপি। ছাত্রদের হয়ে রাস্তায় নেমে পড়ছেন তৃণমূলের জেলা নেতা, এমনকী বিধায়কেরাও। শনিবার সারা দিন ধরে এই ছবিই কার্যত স্পষ্ট হয়ে উঠল। বীরভূমে এমনই পরিস্থিতি দাঁড়ায় যে তা সামাল দিতে শাসকদলের নেতাদের উপরেই লাঠি চালাতে হল পুলিশকে।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ০৪ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:০২
Share:

পুলিশের লাঠির ঘা সিউড়ির বিদ্যাসাগর কলেজের সামনে হাজির তৃণমূলের উপ-পুরপ্রধান উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়কে (বাঁ দিকে)। রানিগঞ্জের টিডিবি কলেজে টিএমসিপির হামলায় আক্রান্ত এবিভিপির জেলা সম্পাদক অবিনাশ চর্তুবেদী। ছবি:দয়াল সেনগুপ্ত এবং ওমপ্রকাশ সিংহ।

যত সময় যাচ্ছে, রাজ্যের ছাত্র রাজনীতিতে প্রধান বিরোধী শক্তি হিসেবে উঠে আসছে অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ (এবিভিপি)। আর, জমি হারানোর আতঙ্কে মারমুখী হয়ে উঠছে টিএমসিপি। ছাত্রদের হয়ে রাস্তায় নেমে পড়ছেন তৃণমূলের জেলা নেতা, এমনকী বিধায়কেরাও।

Advertisement

শনিবার সারা দিন ধরে এই ছবিই কার্যত স্পষ্ট হয়ে উঠল। বীরভূমে এমনই পরিস্থিতি দাঁড়ায় যে তা সামাল দিতে শাসকদলের নেতাদের উপরেই লাঠি চালাতে হল পুলিশকে। আবার পুলিশের ফাইবারের লাঠি হাতেই দাপিয়ে বেড়াল তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীরা। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের ছাত্র শাখা এবিভিপি-র রাজ্য নেতৃত্বের দাবি, এ দিন মনোনয়ন পত্র তোলাকে কেন্দ্র করে রাজ্য জুড়ে তাদের অন্তত ৬১ জন সদস্য মার খেয়েছেন।

পাল্টা হিসেবে এ দিন নয়াদিল্লিতে বঙ্গভবনের সামনে বিক্ষোভ দেখায় এবিভিপি। সোমবার রাজ্য জুড়ে ছাত্র ধর্মঘটের ডাকও দিয়েছে তারা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশ্রয়েই এই আক্রমণ চলছে অভিযোগ করে এবিভিপি-র দিল্লি রাজ্য সম্পাদক সাকেত বহুগুণার হুঁশিয়ারি মমতা যেন ভুলে না যান যে তাঁর দুষ্কৃতীরা রাজ্যেই সীমাবদ্ধ, কিন্তু এবিভিপি ভারত জুড়ে ছড়িয়ে আছে। দিল্লি গেলেই মমতাকে ঘেরাও করা হবে। ঠিক যেমন কিছু দিন আগে দিল্লিতে যোজনা কমিশনে ঢোকার সময়ে বাম ছাত্র-যুবদের বিক্ষোভের মুখে পড়েছিলেন মমতা ও তাঁর অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র। ফারাকের মধ্যে, এ বার বামেদের জায়গা নিয়েছে গৈরিক বাহিনী। সে এই রাজ্যে যেমন, রাজধানীতেও তেমনই।

Advertisement

লক্ষণীয় যে, এবিভিপি মমতাকে ঘেরাও করার হুমকি দিলেও বিজেপি কিন্তু এতে সরাসরি নাক গলায়নি। অথচ বীরভূমে রামপুরহাট কলেজের সামনে দেখা গিয়েছে তৃণমূল বিধায়ক অসিত মালকে। পুলিশের সামনেই দাপিয়ে বেড়িয়েছেন শাসকদলের দুই যুব নেতা। সিউড়ি কলেজে মাফলারে মুখ ঢাকা বহিরাগতদের আটকাতে পুলিশের চালানো লাঠিতে আহত হয়েছেন উপ-পুরপ্রধান ও তৃণমূলের শহর সভাপতি। বর্ধমানে বিবেকানন্দ কলেজে হাজির ছিলেন কাউন্সিলর। যা কার্যত মেনে নিয়ে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “শুধু ছাত্রেরা মারপিট করে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বহিরাগতদের মদত থাকে। সব দলের কাছে অনুরোধ, কলেজ নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বাইরে থেকে মাথা গলাবেন না।” তবে তাঁর দাবি, এ দিন যে ৫১টি কলেজে নির্বাচন প্রক্রিয়া ছিল, তার মধ্যে মাত্র তিনটিতে গোলমাল হয়েছে।

অবশ্য শুধু এবিভিপি নয়। যেখানেই কোনও বিরোধী সংগঠন মনোনয়ন তোলার বা জমা দেওয়ার চেষ্টা করেছে, মারমুখী হয়ে উঠেছে টিএমসিপি তথা তৃণমূল। রামপুরহাট কলেজ সকাল থেকেই মুখ ঢাকা বহিরাগতদের দখলে চলে গিয়েছিল। বিরোধী ছাত্র সংগঠনের প্রতিনিধিদের হাতে পরিচয়পত্র থাকা সত্ত্বেও তাঁদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি। পুলিশের সামনেই তাঁদের মেরে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। গোটা সময়টা কলেজের সামনে ঘুরে বেড়ান শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। কিছু ক্ষণের জন্য ঘুরে যান হাঁসনের তৃণমূল বিধায়ক অসিত মাল। আক্রমণের পুরোভাগে দেখা যায় যুব তৃণমূল নেতা ওয়াসিম আলি ভিক্টরকে। শেষ পর্যন্ত টিএমসিপি ছাড়া আর কেউ মনোনয়ন তুলতে পারেনি। মারে আহত হন এবিভিপি, এসএফআই এবং ছাত্র পরিষদের ছয় সমর্থক। প্রতিবাদে মহকুমাশাসকের দফতরে ভাঙচুর চালানো হয়। তিন সংগঠন একযোগে পথ অবরোধও করে। নলহাটি হীরালাল ভকত কলেজে মনোনয়ন তুলতে বাধা পেয়ে রানিগঞ্জ-মোরগ্রাম ৬০ নম্বর জাতীয় সড়কও অবরোধ করে এবিভিপি।

দুপুরে সিউড়ি বিদ্যাসাগর কলেজে রটে যায়, বাসস্ট্যান্ড থেকে এবিভিপি সমর্থকেরা মিছিল করে কলেজে আসছে। তৃণমূলের উপ-পুুরপ্রধান উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়, দলের শহর সভাপতি অভিজিৎ মজুমদার তখন কলেজের সামনেই ছিলেন। মাফলারে মুখ ঢাকা এক দল লোক পুলিশের ব্যবহার করার ফাইবারের লাঠি হাতে বাসস্ট্যান্ডের দিকে ছোটে। সামনে পড়ে যান এক দল এসএফআই সদস্য। তাদের দু’জন এবং সিপিএমের সিউড়ি জোনাল সম্পাদকের উপরে লাঠির ঘা পড়ে। সেই সময়েই কিছু দূরে বোমা ফাটে। গোলমাল আঁচ করে পুলিশ লাঠি চালাতে শুরু করলে তৃণমূলের লোকেরাই বেশি মার খান।

পুলিশের লাঠি তৃণমূলের লোকের হাতে গেল কী করে? শাসকদলেরই একটি সূত্রের দাবি, দলের যে সমস্ত কর্মী সিভিক ভলান্টিয়ার্স হিসেবে কাজ পেয়েছেন, তাঁদের থেকে লাঠিগুলি জোগাড় করা হয়েছে। তা ছাড়া, কিছু দিন আগে র্যাফের কাছ থেকে কিছু লাঠি চুরি গিয়েছিল। তা-ও হাত ঘুরে দুষ্কৃতীদের হাতে এসেছে। বীরভূমের পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়ার বক্তব্য, “ওই লাঠি সাধারণত পুলিশই ব্যবহার করে। তবে এমনটা নয় যে, এই লাঠি বাজারে পাওয়া যায় না।” যদিও কোথায় ওই ধরনের লাঠি কিনতে পাওয়া যায়, পুলিশের কাছে তার সদুত্তর মেলেনি। পুলিশ সুপার অবশ্য আশ্বাস দিয়েছেন, “লাঠিগুলো ওদের হাতে কী ভাবে গেল তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।”

বাঁকুড়ার শালডিহা ও রাইপুর বীরসা মুন্ডা কলেজে মনোনয়ন তুলতে গিয়ে টিএমসিপি সমর্থকদের ছোড়া ইটে এবিভিপি এবং এসএফআইয়ের আট জন আহত হন। বর্ধমানের রানিগঞ্জ টিডিবি কলেজে টিএমসিপি-র মারে আহত হন এবিভিপি-র জেলা সম্পাদক অবিনাশ চর্তুবেদী-সহ ৫ জন। তাঁদের অবশ্য কলেজের ধারে-কাছেই ঘেঁষতে দেওয়া হয়নি। কিলোমিটার খানেক আগেই তাঁদের আটকে মারধর করা হয়। পরে বিজেপির পার্টি অফিসেও ভাঙচুর চলে। কুলটি কলেজে মনোনয়ন তোলা নিয়ে এসএফআই-টিএমসিপি সংঘর্ষ হয়। পরে কুলটি থানায় বিক্ষোভ দেখায় এসএফআই। গলসি মহাবিদ্যালয়েও মনোনয়ন তুলতে গিয়ে টিএমসিপি-র আক্রমণের মুখে পড়ে এসএফআই। কলেজে গিয়ে আহত হন সিপিএমের গলসি জোনাল কমিটির প্রাক্তন সম্পাদক সৈয়দ হোসেন-সহ ৬ জন। বর্ধমানের পুলিশ সুপার সৈয়দ মহম্মদ হোসেন মির্জা অবশ্য দাবি করেন, “কোথাও বড় গোলমাল হয়নি। গলসিতে সিপিএম নেতার মার খাওয়ার সঙ্গে কলেজ নির্বাচনের কোনও সম্পর্ক নেই।”

শুধু যে মনোনয়ন তোলা নিয়ে গোলমাল, তা নয়। হাওড়ার কলেজে মনোনয়ন তোলা এখনও শুরু হয়নি। তা সত্ত্বেও ডোমজুড় আজাদ হিন্দ ফৌজ মহাবিদ্যালয়ের কিছু এবিভিপি সমর্থককে শুক্রবার রাতে তৃণমূলের লোকেরা মারধর করে বলে অভিযোগ। তার প্রতিবাদে এ দিন দুপুরে কলেজের সামনে বিক্ষোভ দেখায় এবিভিপি। আবার, ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও প্রথম বর্ষে পড়ুয়া ভর্তির দাবিতে দুপুরে মালদহের কালিয়াচক কলেজে তাণ্ডব চালায় টিএমসিপি। অধ্যক্ষার টেবিল, চেয়ার, টিভি, কম্পিউটার ও সিসিটিভি ক্যামেরা ভেঙে দেওয়া হয়। কয়েক জন শিক্ষক চোট পান। শিলিগুড়ির বাগডোগরা কলেজে অবশ্য এক ছাত্রীকে উত্ত্যক্ত করা নিয়ে গোলমালে টিএমসিপি-রই কয়েক জন নেতা এবিভিপি সমর্থকদের হাতে মার খান।

এ দিন বর্ধমানে গিয়ে বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ দাবি করেন, “কলেজগুলিতে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভোট হলে যে বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রী এবিভিপি-কে সমর্থন করবে তা পুরুলিয়ায় প্রমাণ হয়ে গিয়েছে। তাই জমি হারানোর ভয়ে টিএমসিপি সন্ত্রাস করছে।” কলকাতায় বিজেপি-র যুব মোর্চা এবিভিপি-র সমর্থনে কলেজ স্ট্রিট থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত মিছিল করে। শিক্ষামন্ত্রীর কুশপুতুলও পোড়ানো হয়। দুপুরে মানিকতলা মোড়ে বিক্ষোভ দেখায় এবিভিপি। টিএমসিপি-র রাজ্য সভাপতি অশোক রুদ্র অবশ্য সব অভিযোগ উড়িয়ে দাবি করেন, “বিজেপি-ই ধানবাদ থেকে দুষ্কৃতী ভাড়া করে এনেছিল। এসএফআই আর এবিভিপি এক হয়ে আমাদের উপরে হামলা চালাচ্ছে।” বর্ধমান পুর উৎসবের উদ্বোধনে গিয়ে রাজ্যের মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের মন্তব্য, “হিংসা কাম্য নয়। কিন্তু কলেজ ভোটে চিরকালই একটু-আধটু গোলমাল হয়।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন