টাকা সরাতে খোলা হয় লোকসানের সংস্থা

মাত্র ছ’বছরে আমানতকারীদের কাছ থেকে প্রায় ২৪৬০ কোটি টাকা তুলেছিল সারদা গোষ্ঠী। চার বছরের মধ্যে এই গোষ্ঠীর অধীনে জন্ম নিয়েছিল ২৩৯টি সংস্থা। এবং সেই প্রতিটি সংস্থাই নাকি লোকসানে চলত! সরকারি সংস্থা রেজিস্ট্রার অব কোম্পানিজ (আরওসি)-এর কাছে সুদীপ্ত সেনের সারদা গোষ্ঠী ফি বছর যে অডিট রিপোর্ট পেশ করেছে, সেখানেই এমন দাবি করা হয়েছে।

Advertisement

অত্রি মিত্র

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:১০
Share:

মাত্র ছ’বছরে আমানতকারীদের কাছ থেকে প্রায় ২৪৬০ কোটি টাকা তুলেছিল সারদা গোষ্ঠী। চার বছরের মধ্যে এই গোষ্ঠীর অধীনে জন্ম নিয়েছিল ২৩৯টি সংস্থা। এবং সেই প্রতিটি সংস্থাই নাকি লোকসানে চলত! সরকারি সংস্থা রেজিস্ট্রার অব কোম্পানিজ (আরওসি)-এর কাছে সুদীপ্ত সেনের সারদা গোষ্ঠী ফি বছর যে অডিট রিপোর্ট পেশ করেছে, সেখানেই এমন দাবি করা হয়েছে। ইডি-র তদন্তকারীদের দাবি, আয়কর ও কেন্দ্রীয় শুল্ক ফাঁকি দিতে ভুয়ো ব্যালান্স শিট তৈরি করত সারদা গোষ্ঠী। সেটাই অডিট রিপোর্ট হিসেবে আরওসি-র কাছে পেশ করে সব সংস্থার লোকসান দেখানো হতো। সারদা গোষ্ঠীর নথিপত্র খতিয়ে দেখার পাশাপাশি সুদীপ্ত সেন, দেবযানী মুখোপাধ্যায়-সহ সংস্থার একাধিক অফিসার-কর্মীকে জেরা করে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) যে প্রাথমিক রিপোর্ট তৈরি করেছে, তাতেই এই বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।

Advertisement

কী বলা হত ভুয়ো ব্যালান্স শিটে?

সারদা-র এক উচ্চপদস্থ কর্তাকে জেরা করে তদন্তকারীরা জেনেছেন, আমানতকারীদের কাছ থেকে আদায় করা টাকা ‘ক্রেতাদের থেকে অগ্রিম’ হিসেবে দেখিয়ে তা লেখা হত ব্যালান্স শিটের দায় (লায়াবিলিটি)-এর ঘরে। আর ওই টাকা ব্যয় করা হত রাজ্য ও রাজ্যের বাইরে সম্পত্তি কেনায়। কিন্তু সেই সম্পত্তির পুরো হিসেব আবার লেখা হত না হিসেবের খাতায়।

Advertisement

ইডি তদন্তে দেখেছে, আমানত তোলার পরিমাণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নিত্যনতুন নামে কোম্পানি খুলে তাতে ওই টাকা চালান করে দিয়েছেন সুদীপ্তবাবু। ইডি-র দেওয়া তথ্য বলছে, ২৩৯টি লিমিটেড কোম্পানি এবং ৩২টি অংশীদারি কোম্পানি নিয়ে গড়ে উঠেছিল সারদা-সাম্রাজ্য। যদিও বাজার থেকে টাকা তোলা হত মাত্র চারটি কোম্পানির মাধ্যমে। সেগুলি হল, সারদা ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস, সারদা রিয়েলটি, সারদা হাউসিং এবং সারদা গার্ডেন রিসর্ট অ্যান্ড হোটেলস। এই চার কোম্পানির টাকা তোলার পরিমাণ যত বেড়েছে, সেই অনুপাতেই বেড়েছে নতুন কোম্পানি খোলার সংখ্যা। ইডি জেনেছে, ২০০৯ সালে সারদার মোট কোম্পানির সংখ্যা ছিল ১৩। ২০১০, ’১১ এবং ’১২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে ৪৪, ১৭২ এবং ২৩৯। সবগুলিই লোকসানে চলা সংস্থা বলে দাবি ছিল সারদা-র। এতগুলো সংস্থার জন্ম দেওয়া এবং সেগুলির খাতায় লোকসান দেখানোর কাজ করতে গিয়ে সারদা সংস্থার সঙ্গে কোম্পানি দফতর, বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ব্যাঙ্কের কর্মীদের একাংশের অশুভ আঁতাঁতও গড়ে ওঠে বলে অনুমান তদন্তকারীদের।

সুদীপ্ত সেন তদন্তকারীদের কী বলেছেন? গত বছরের ১০ অক্টোবর ইডি-র প্রশ্নের জবাবে সুদীপ্তবাবু বিবৃতি দিয়ে জানান, “আমি জানতাম, কোনও দিনই এত চড়া সুদ-সহ টাকা ফেরত দিতে পারব না। কিন্তু বাজার থেকে যে হারে টাকা উঠছিল, তা চলতে থাকলে পুরনো আমানতকারীদের টাকা ফেরানোয় সমস্যা হত না। এই ভাবে নতুন টাকার জোগান যত দিন থাকত, আমার ব্যবসাও চলত।” ইডি-র জেরায় সারদা গোষ্ঠীর একাধিক কর্তা জানিয়েছেন, নতুন টাকার জোগান থেকেই আমানতকারীদের ৪৭৭ কোটি টাকা ফেরত দিয়েছিল সারদা গোষ্ঠী।

তদন্তের দায়িত্ব নেওয়ার পর গত বছরের জুন থেকে সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেন, দেবযানী মুখোপাধ্যায় এবং সংস্থার বিভিন্ন স্তরের অফিসার-কর্মীকে জেরার ভিত্তিতে একটি প্রাথমিক রিপোর্ট তৈরি করেছে ইডি। সারদা গোষ্ঠী ঠিক কত টাকা তছরুপ করেছে, সেই তথ্য উঠে এসেছে রিপোর্টে। ইডি-র যুগ্ম অধিকর্তা সত্যেন্দ্র মাথুরিয়া অর্থ মন্ত্রকে ওই রিপোর্ট পাঠিয়েছেন। তাতে বলা হয়েছে, ২৪৫৯ কোটি ৪৭ লক্ষ টাকা আমানতকারীদের থেকে আদায় করা হলেও ফেরত দেওয়া হয়েছিল ৪৭৭ কোটি টাকা। সারদা গোষ্ঠীর সব সংস্থার ঝাঁপ বন্ধ হয়েছে গত বছরের ১৬ এপ্রিল। তদন্তকারীদের বক্তব্য, ওই দিন পর্যন্ত বাকি অর্থ, অর্থাৎ প্রায় ১৯৮৩ কোটি টাকার কেলেঙ্কারি হয়েছে। আমানতকারীদের ফেরত না দিয়ে সেই টাকায় সারদা-কর্তা ইচ্ছেমতো নামে-বেনামে সম্পত্তি কিনেছেন, অকাতরে বিলিয়েছেন অথবা স্রেফ উড়িয়ে দিয়েছেন বলেই দাবি তদন্তকারীদের।

ইডি-র একটি সূত্র এবং ফরেন্সিক অডিট সংস্থার প্রাথমিক রিপোর্ট থেকে জানা গিয়েছে, সারদায় আর্থিক কেলেঙ্কারির যে পরিমাণ, তার এক-তৃতীয়াংশ খরচের ক্ষেত্রে কিছু সূত্র পাওয়া গিয়েছে। যেমন, সারদার এজেন্টদের কমিশন বাবদ ব্যয়, সম্পত্তি কেনা এবং সংবাদমাধ্যমে বিনিয়োগের জন্য টাকা ঢেলেছিলেন সুদীপ্ত সেন। বাকি প্রায় ৬০০ কোটি টাকার হিসেব নেই। এই টাকাটাই হাতে-হাতে উবে গিয়েছে বলে জেনেছেন গোয়েন্দারা।

ইডি-র এক কর্তা বলেন, “আর্থিক কেলেঙ্কারির হিসেব-নিকেশের পর আমরা খোঁজ করছি, আমানতকারীদের এত টাকা কারা আত্মসাৎ করেছে। একাধিক নেতা-নেত্রী জড়িত ছিলেন বলেই আমাদের ধারণা।”

তদন্তের কাজে যুক্ত হায়দরাবাদের ফরেন্সিক অডিট সংস্থা শরৎ অ্যাসোসিয়েটস-এর দেওয়া প্রাথমিক রিপোর্টে বলা হয়েছে, সারদার ৩২০টি শাখা অফিসের প্রতি মাসের প্রশাসনিক ও বিবিধ ব্যয় ছিল ৩৩ কোটি টাকা। ইডি মনে করে, এই প্রশাসনিক ও বিবিধ ব্যয়ের অছিলাতেই নগদ টাকা চলে গিয়ে থাকতে পারে প্রভাবশালী বিভিন্ন মহলের হাতে। অর্থ মন্ত্রকে ইডি-র দেওয়া প্রাথমিক রিপোর্টে এ-ও বলা হয়েছে, আমানতকারীদের থেকে যে টাকা তোলা হত, তা উপযুক্ত বিনিয়োগ প্রকল্পে খাটানোর কোনও পরিকল্পনাই ছিল না সুদীপ্ত সেনের। ওই টাকায় জমি-বাড়ি-ফ্ল্যাট ইত্যাদি সম্পত্তি কিনে এবং বেশ কিছু লোকসানে চলা সংস্থায় বিনিয়োগ করেছিলেন তিনি। এ ধরনের বিনিয়োগের আসল উদ্দেশ্য যে বাজার থেকে তোলা টাকা সরিয়ে ফেলা, তারও প্রমাণ পেয়েছে ইডি।

ওই ফরেন্সিক অডিট সংস্থার প্রাথমিক রিপোর্টের আরও বক্তব্য, রাষ্ট্রায়ত্ত এবং বেসরকারি ব্যাঙ্কের একাংশের কর্তাদের সঙ্গে অশুভ আঁতাঁত গড়ে একই নামে ‘কেওয়াইসি’ ছাড়াই ২০ থেকে ৫০টি পর্যন্ত অ্যাকাউন্ট খুলেছিল সারদা। সেই সব অ্যাকাউন্টে যথেচ্ছ লেনদেন হয়েছে। যা নিয়ম বিরুদ্ধ। ফরেন্সিক অডিট সংস্থাটি জেনেছে, অডিট রিপোর্টে সারদার আয়-ব্যয়ের যে হিসেব দেখানো হয়, তার সঙ্গে তাদের আর্থিক কর্মকাণ্ডের কোনও মিল ছিল না। বাজার থেকে ওঠা টাকার অতি সামান্য অংশ ব্যাঙ্কে জমা পড়েছে। পরিস্থিতি এমনই দাঁড়িয়েছিল যে সুদীপ্ত সেন কলকাতা ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পরে সারদার ৩৩৪টি অ্যাকাউন্ট থেকে মাত্র ৬৮ লক্ষ টাকা উদ্ধার হয়েছিল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন