তাপপ্রবাহ থেকে কলকাতার বুঝি মুক্তি নেই!
তাপমাত্রা রোজ একই থাকছে না, ওঠানামা করছে। তবে এ সময়ের স্বাভাবিকের মাত্রার কাছে কখনওই পৌঁছচ্ছে না। নীচে নামলে ৩৯। উপরে উঠলে সাড়ে ৪১। দুটোই এ সময়ের সর্বোচ্চ স্বাভাবিক তাপমাত্রার থেকে ৪-৫ ডিগ্রি বেশি। আগামী দিন দুই এমনই চলবে বলে পূর্বাভাস। তার পরেই যে স্বস্তি মিলবে, এমন আশ্বাসও শোনাচ্ছে না হাওয়া অফিস।
ভোর ছ’টা থেকেই সূর্যের তাপে নাজেহাল মানুষ। প্রাতর্ভ্রমণকারীরা ঘেমেনেয়ে একাকার। সন্ধ্যায় সওয়া ছ’টা নাগাদ সূর্য অস্ত যাওয়ার পরেও নিস্তার নেই। সাধারণত, সূর্য ডোবার পর থেকেই মাটি থেকে তাপ বিকিরিত হতে শুরু করে। রাত যত গড়ায়, তাপ বিকিরণের ফলে ততই ঠান্ডা হয় মাটি-পরিবেশ। ভোরের দিকে অন্তত পরিবেশটা মোলায়েম থাকে। কিন্তু এ বার তেমনটা হচ্ছে না কেন?
আবহবিদদের ব্যাখ্যা, কলকাতার তাপমাত্রা টানা ৪০ ডিগ্রির আশপাশে থাকায়, মাটি এতটাই উত্তপ্ত হচ্ছে, যে রাতভর তাপ বিকিরণের পরেও মাটি ঠান্ডা হচ্ছে না। ফলে ভোরের দিকেও গরম ভাবটা থাকছে। রোদ ওঠার পর থেকেই ফের শুরু হচ্ছে জ্বলুনি। আলিপুর হাওয়া অফিসের এক বিজ্ঞানী জানাচ্ছেন, রাতেও তাপমাত্রা স্বাভাবিকের থেকে অনেকটা বেশি থাকায় সকালে সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই ফের গরম হতে শুরু করছে মাটি এবং দ্রুত তা ৩৭-৩৮ ডিগ্রি ছুঁয়ে ফেলছে।
শহরে এই দহনের পিছনে অন্য একটি কারণও দেখাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। তাঁরা বলছেন, শহরে গাছপালা দ্রুত হারিয়ে যাওয়ায় কংক্রিটের জঙ্গল দ্রুত একটা গ্যাস চেম্বারে পরিণত হচ্ছে। কংক্রিটের দেওয়াল থেকে গভীর রাতেও তাপ পুরো বায়ুমণ্ডলে মিশতে পারছে না। ফলে শহর উত্তপ্ত থেকে যাচ্ছে। “মাটির তুলনায় কংক্রিটের তাপধারণ ক্ষমতা অনেক বেশি।”বলছেন এক পরিবেশবিজ্ঞানী।
কংক্রিটের এই তাপধারণ ক্ষমতার জন্যই ছুটির দিনেও ঘরে টেকা যাচ্ছে না। বহুতলগুলির ছাদে ট্যাঙ্কের জল পর্যন্ত গরম হয়ে যাচ্ছে।
পরিবেশ বিজ্ঞানীদের একাংশ বলছেন, মহানগরীতে জলাশয় এবং পুকুরের সংখ্যা দ্রুত কমে যাওয়ার সরাসরি প্রভাব পরিমণ্ডলের উপরে পড়তে শুরু করেছে। তাপ যত বাড়ে, ততই পুকুরের জল বাষ্পীভূত হয়ে উঠে যায় উপরে। তাতে মেঘ সঞ্চারের সম্ভাবনাও বেড়ে যায়। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের ওই অংশটি বলছেন, মহানগরীতে পুকুর বেশি থাকলে বাষ্পীভবন বাড়ত। তা হলে মেঘ তৈরি হত। গরম বায়ু উপরে ওঠার সময়ে বায়ুর চাপের তারতম্য ঘটত। যা ঝড়-বৃষ্টির সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলত। পুকুরের ধারে ধারে বড় বড় গাছ লাগানো থাকলে তা ফিল্টারের কাজ করে। পুকুরের জলের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়ার সময়ে গরম বাতাসের তাপমাত্রা কমে যায়। তার পরে সেই বাতাস গাছের ফাঁক দিয়ে বেরোনোর সময়ে তার তাপমাত্রা আরও কমে যায়। এক পরিবেশবিদের মন্তব্য, “এই প্রাকৃতিক বাতানুকূল ব্যবস্থা হারিয়ে যাওয়াতেই শহরের মানুষকে গরমে এত কষ্ট পেতে হচ্ছে।”
তাপপ্রবাহের এই চোখ রাঙানির মধ্যেই শহরে হাজির হয়েছে হিট ডায়েরিয়া। পেটের অসুখের সঙ্গে থাকছে জ্বর। এ রোগে শরীর থেকে এতটাই জল বেরিয়ে যাচ্ছে যে, রোগীর খিঁচুনি হচ্ছে। হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে স্যালাইন দিতে হচ্ছে। হিট ডায়েরিয়া এড়াতে এই সময়ে পেটের অসুখ হলেই নুন-চিনির জল খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিত্সকেরা। ওষুধ খাওয়ার ব্যাপারে সতর্ক থাকারও পরামর্শ দিচ্ছেন তাঁরা। চিকিত্সকদের পরামর্শ: হাল্কা পোশাক পরুন, মশলাহীন খাবার ও লাউ, পেঁপে, চালকুমড়োর মতো রসালো সব্জি ও তরমুজ, ফুটির মতো রসালো ফল খান। পথে বেরোলে ছাতা ও রোদচশমা ব্যবহারের উপরেও জোর দিচ্ছেন চিকিত্সকেরা।