শনিবার ধৃত আখতার খান। সোমবার ধৃত জাফর খান (বাঁ দিকে)।
একেই পাকিস্তানি ব্যাঙ্কের ডেবিট কার্ড। তা দিয়ে কিনা কলকাতার নানা প্রান্তে এটিএম থেকে নিয়মিত টাকাও উঠছে!
খবর পেয়ে নড়েচড়ে বসেছিলেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা। শুরু হয় নজরদারি। যার পরিণামে পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআইয়ের ‘কলকাতা নেটওয়ার্ক’ ফাঁস হয়ে গিয়েছে বলে গোয়েন্দাদের দাবি।
আইএসআই এজেন্ট হিসেবে কাজ করার অভিযোগে শনিবার কলুটোলায় ধরা হয়েছিল আখতার খান নামে এক ব্যক্তিকে। আর সোমবার কলিন স্ট্রিটে গ্রেফতার হয়েছে আখতারের ভাই জাফর। লালবাজারের স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্সের (এসটিএফ) খবর, দু’ভাইয়ের কাছেই সন্দেহজনক নথি পাওয়া গিয়েছে। মিলেছে পাকিস্তানি পাসপোর্ট। তাদের এক শাগরেদকে ইতিমধ্যে নজরবন্দি করা হয়েছে। কলকাতা পুলিশ ও কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের দৃঢ় ধারণা, জাতীয় নিরাপত্তা-প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাকিস্তানে পাচারে খান ভাইদের বড় ভূমিকা রয়েছে।
এবং এই ‘চর-চক্র’ ফাঁসের নেপথ্যে পাকিস্তানের হাবিব ব্যাঙ্কের সেই ইন্টারন্যাশনাল ডেবিট কার্ডটির ভূমিকাও এক বাক্যে মানছেন গোয়েন্দারা। তাঁরা জানাচ্ছেন, ওই কার্ড মারফত আখতার কলকাতার নানা এটিএম থেকে নিয়মিত টাকা তুলে যাচ্ছিল। এর দৌলতেই বিষয়টি প্রথম নজরে আসে। আখতারের আয়ের উৎস সম্পর্কে খোঁজ-খবর চালিয়ে সন্দেহ বাড়ে। উপরন্তু দেখা যায়, আখতার আবার ওই টাকার কিছুটা জমা করছে পাকিস্তানের আর এক ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টে, তার দু’ছেলের নামে। ‘‘এতে আমরা নিশ্চিত হয়ে যাই যে, আখতার খানের পাক সংশ্রব দীর্ঘ দিনের।’’— মন্তব্য এক তদন্তকারীর।
দুইয়ে-দুইয়ে চার করতে দেরি হয়নি। একান্ন বছরের আখতারকে ঘিরে নজরদারির জাল বিছানো হয়। শেষমেশ শনিবার রাতে তার গ্রেফতারি। দাদাকে জেরা করে এ দিন আটচল্লিশ বছরের ভাইকে হেফাজতে নেওয়ার পরে গোয়েন্দাদের দাবি, আখতার ও জাফর, দু’জনেই বহু বছর পাকিস্তানে কাটিয়ে এসেছে। আইএসআইয়ের তরফে ওদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন সেনাছাউনি, বায়ুসেনা-ঘাঁটি ও বন্দরের ছবি-নথি ইত্যাদি জোগাড় করার। ‘‘ওরা কলকাতার হরেক সাইবার ক্যাফে থেকে ই-মেল করে সেগুলো আবার নিয়োগ কর্তাদের পাঠিয়ে দিত’’, এ দিন বলেন এসটিএফের এক অফিসার। সংশ্লিষ্ট কয়েকটি সাইবার ক্যাফেকে ওঁরা চিহ্নিতও করে ফেলেছেন।
কিন্তু প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত এত গোপনীয় নথিপত্র ওরা পেত কী ভাবে?
গোয়েন্দাদের ব্যাখ্যা, এর মূলে রয়েছে খান ভাইদের পানীয় তৈরির হাতযশ। দু’জনেই ‘মকটেল’ ও ‘ককটেল’ তৈরিতে ওস্তাদ। বার টেন্ডারের কাজের সুবাদে সেনাবাহিনী ও বন্দরের বিভিন্ন পার্টিতে ওদের আনাগোনা ছিল অবাধ। তারই সুযোগে ওরা বিভিন্ন তথ্য হাতিয়ে নিয়েছে বলে তদন্তকারীদের অনুমান। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার এক অফিসারের কথায়, ‘‘বারটেন্ডারের কাজের সূত্রে পুলিশের কয়েক জন অফিসারের সঙ্গেও আখতারের বিলক্ষণ চেনা-জানা ছিল।’’ ফলে পুলিশেরও বেশ কিছু খবর বিদেশে পাচারের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
এ দিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্তা বলেন, জাফর-আখতার যুগলবন্দিতে কী কী নথি পাকিস্তানে পাচার হয়েছে, তার কিছুটা আন্দাজ মিলেছে। বাকিটা জেরা করে জানার চেষ্টা চলছে। এ জন্য বন্দরের নিরাপত্তা সংস্থার সঙ্গেও যোগাযোগ করা হয়েছে।
আখতার-জাফরের অতীত কী?
গোয়েন্দা-তথ্য মোতাবেক, দু’জনেরই ছোটবেলা কেটেছে কলিন স্ট্রিটের মামাবাড়িতে। আশির দশকে তারা করাচি চলে যায়, কাকা ইজরায়েল খানের কাছে। সেখানে এক কারখানায় তারা কাজ করত। আখতার এক পাক-কন্যাকে বিয়েও করে। ২০০৯-এ জাফর ভারতে ফিরে আসে।
এ পর্যন্ত সব ঠিকঠাক ছিল। মোড় ঘুরল ২০১১-য়, যখন আখতারও ফিরে এল। কেন?
পুলিশের দাবি, ভারতে ফেরার আগে আখতার আইএসআইয়ের খপ্পরে পড়ে গিয়েছিল। বস্তুত পাক-এজেন্ট হয়েই তার প্রত্যাবর্তন। শুধু তা-ই নয়, নিজের ভাই-সহ এখানকার বেশ কিছু লোককে সে চর-চক্রে সামিল করে। ‘‘আখতার এ দেশে জাফর-সহ অন্তত পনেরো জনকে আইএসআইয়ের কাজে লাগিয়েছিল। বাকিদের উপরেও নজরদারি রয়েছে।’’— বলছেন এক গোয়েন্দা-অফিসার।