দুঃসময়ে ফের সংস্কৃতি জগতের কাছে বুদ্ধ

দু’দশক আগে নিজে লিখেছিলেন ‘দুঃসময়’। সে ছিল নাটক। এখন রাজনৈতিক ভাবেই দুঃসময়ে বামেরা। এবং সেই সঙ্কটের মুহূর্তে ফের এগিয়ে এলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যই। এ বার আর নিজে নাট্যকার হয়ে নয়। সাংস্কৃতিক জগতের সঙ্গে সেতুবন্ধনের চেষ্টায়।

Advertisement

সন্দীপন চক্রবর্তী

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ মার্চ ২০১৪ ০৪:০৬
Share:

দু’দশক আগে নিজে লিখেছিলেন ‘দুঃসময়’। সে ছিল নাটক। এখন রাজনৈতিক ভাবেই দুঃসময়ে বামেরা। এবং সেই সঙ্কটের মুহূর্তে ফের এগিয়ে এলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যই। এ বার আর নিজে নাট্যকার হয়ে নয়। সাংস্কৃতিক জগতের সঙ্গে সেতুবন্ধনের চেষ্টায়।

Advertisement

লোকসভা ভোটের মুখে রাজ্যের শিল্পী, সাহিত্যিক, শিক্ষক, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে মুখোমুখি বসতে চলেছেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। ‘এসো অপরাজিত বাণী, অসত্য হানি’ এই আহ্বান নিয়ে এমন আসরের মুখ্য চরিত্র বুদ্ধবাবুই। ময়রা স্ট্রিটে বিড়লা হাইস্কুলের বিদ্যামন্দির অডিটোরিয়ামে আগামী ৫ এপ্রিল সংস্কৃতি জগতের সঙ্গে আলোচনায় বামেদের তরফে বক্তাও বুদ্ধবাবু স্বয়ং। মুখ্যমন্ত্রী তথা তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী থাকার সময়ে যে মহলের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল নিবিড়, কঠিন সময়ে তিনিই হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন সেই জগৎকে ফের কাছে টানতে।

পরিবর্তনের প্রবল হাওয়ায় রাজ্যের শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি দুনিয়ার একের পর এক ব্যক্তিত্ব যখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শিবিরে চলে যাচ্ছিলেন, তিন বছর আগে সেই সময়ে একই ভাবে উদ্যোগী হয়েছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধবাবু। বিধানসভা ভোটের আগে সেই অনুষ্ঠানে কলামন্দির ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রীর কাছে শিল্পী, সাহিত্যিকদের প্রশ্ন ছিল, সিঙ্গুরে হাইওয়ের ধারে বিরোধী নেত্রী ধর্না দিচ্ছেন এবং গাড়ি কারখানার কাজ আটকে যাচ্ছে দেখেও কেন প্রশাসন উদ্যোগী হল না বাধা সরাতে?

Advertisement

মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধবাবু ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, পুলিশ দিয়ে ধর্না তুলতে গেলে

আরও হইচই, সমস্যা বাড়ত। বিরোধীদের উপরে তিনি ভরসা করেছিলেন এবং ভুল করেছিলেন। ভবিষ্যতে এই উদাহরণ তিনি মনে রাখবেন বলে সে দিন বিশিষ্টদের আশ্বাস দিয়েছিলেন বুদ্ধবাবু।

এ বারের পরিস্থিতি ভিন্ন। বামেরা সরকারে নেই। পরিবর্তনপন্থী বিশিষ্টদের কারও কারও নতুন সরকারের প্রতি মোহভঙ্গ হলেও বাম শিবির ছেড়ে যাওয়ার ঘটনা বন্ধ হয়নি। সদ্যই তৃণমূল প্রার্থী অর্পিতা ঘোষকে সমর্থনের কথা বলে বাম মহলে চাঞ্চল্য তৈরি করেছেন কবি সুবোধ সরকার। যে ঘটনায় ‘ব্যথিত’ হয়েছেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুও। এমন প্রেক্ষাপটে বুদ্ধবাবুর মনে হয়েছে, যে ভাবে নরেন্দ্র মোদীর নামে জয়ধ্বনি চলছে এবং তৃণমূলের দাপট যে চেহারা নিচ্ছে, সে সব মাথায় রেখেই বিশিষ্টদের সঙ্গে মুখোমুখি বসা দরকার। দলের অন্দরে বুদ্ধবাবুর যুক্তি, বামেদের ভুলের জন্য অনেক মানুষ পাশ থেকে সরে গিয়েছিলেন। রাজনৈতিক ভাবে হারানো জমি ফিরে পেতে গেলে এঁদের মধ্যে যত বেশি মানুষকে সম্ভব, ফেরানো দরকার। ভোটের অঙ্কে দুর্বল হয়ে পড়লেও সাধারণ মানুষের স্বার্থরক্ষায় এবং ধর্মনিরপেক্ষতার প্রহরী হিসাবে বামেরাই এখনও নির্ভরযোগ্য সেনানী। এই বার্তাই ৫ তারিখ বিদ্যামন্দিরের মঞ্চ থেকে দিতে চান বুদ্ধবাবু।

পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘ-সহ বামপন্থী এক গুচ্ছ সাংস্কৃতিক ও শিক্ষক সংগঠনের তরফে ওই অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ পৌঁছতে শুরু করেছে বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশিষ্টদের কাছে। বামফ্রন্টের দুর্দিন দেখে অন্য শিবিরে যাননি, শিল্প ও সংস্কৃতি জগৎ থেকে এমন উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক বলতে এখনও আছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। বাম সূত্রের খবর, সে দিন আলোচনার আসরে দেখা যেতে পারে তাঁকে। রাজনীতির শিবির বিভাজন যাঁকে কোনও কালেই স্পর্শ করতে পারেনি, এমন আর এক ব্যক্তিত্ব, কবি শঙ্খ ঘোষ আমন্ত্রণ পান কি না বা পেলেও আসেন কি না, তা এখনও দেখার। কিন্তু সংস্কৃতি জগতের এই ব্যক্তিত্বেরা কি লক্ষ লক্ষ ভোটারের উপরে প্রভাব ফেলতে পারেন? সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের মতে, “তা হয়তো পারেন না। কিন্তু সমাজের বিবেক হিসাবে তাঁদের নিশ্চয়ই একটা ভূমিকা আছে। যে ভাবে সাম্প্রদায়িকতার আগ্রাসন চলছে, রাজ্যে গণতন্ত্র ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে, এই অবস্থায় শিক্ষা ও সংস্কৃতি জগৎ সচেতনতার পরিমণ্ডল তৈরিতে সহায়ক হতে পারে।”

বুদ্ধবাবুর অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণলিপিতে লেখা হয়েছে: ‘দেশের শাসন তখ্তে শ্যেন দৃষ্টি হেনেছে ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধীশ্বরদের লাগামহীন দুর্নীতির দাপটে ধ্বস্ত স্বদেশ’। আর এ রাজ্য? বলা হচ্ছে: ‘জীবনের সর্ব-অসম্মানে পীড়িত আমাদের প্রিয় পশ্চিমবঙ্গও। পদদলিত গণতন্ত্র। আহত নারীর সম্ভ্রম। সর্বগ্রাসী ক্ষমতার আস্ফালন শিক্ষা ও সংস্কৃতির যুগসঞ্চিত মূল্যবোধগুলির উপরে ঘনিয়ে তুলেছে সর্বনাশের ছায়া’। সঙ্গে অবশ্য থাকছে আশার কথাও ‘সংক্ষুব্ধ সময়ের এই আবহেই সম্মিলিত কণ্ঠে মুখরিত ধর্মনিরপেক্ষ ও জনমুখী বিকল্প পথের প্রত্যয় ধ্বনি’।

সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার একটি সংস্থার সদস্য হিসাবে নাম লেখালে তবেই নাট্যসংস্থাগুলি সরকারি অনুদান পাচ্ছে, ওই সংস্থার স্বীকৃতি না-থাকলে নানা উৎসবে ডাক পেয়েও বাতিল হচ্ছে নাট্য দলের আমন্ত্রণ এমন নানা অভিযোগই হালফিল বুদ্ধবাবুর কাছে পৌঁছেছে। এক নাট্যকারের কথায়, “যাঁরা ঘোষিত ভাবেই তৃণমূলের সঙ্গে, তাঁদের ডাকা যাবে না। বাকি সকলকে নিয়ে পরিস্থিতি আলোচনা করবেন বুদ্ধবাবু।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন