মনফকিরা মিলনমেলা
কবিদের মেলা জয়দেব? নাকি বাউল-ফকির-কীর্তনের আখড়া কেঁদুলি?
মেলা-মোচ্ছব সরিয়ে একদিকে কবি জয়দেব থেকে শক্তি চট্টোপাধ্যায়, অন্যদিকে নবনী দাস বাউল থেকে গৌড়খ্যাপার মকরে ঠাঁই ছিল কেঁদুলিতে। হাত থেকে হাতে ঘোরা ছিলিমের ধোঁয়ায় ঢাকা আখড়ায় কবিতা আর বাউল সুরের হাওয়ায় ফি বছর অজয়ের চর এখনও ভাসে মকর সংক্রান্তির নিশিভোরে। সেই কবে থেকে অজয়ের স্রোত ছোঁওয়ানো এই মেলায় সহজিয়া সুর আর সাহিত্যবাসরের টানে পা পড়ে এলিট থেকে দীন-দুখিজনের। কথিত আছে, কবি জয়দেব প্রতি বছর মকর স্নানে যেতেন কাটোয়ায় গঙ্গায়। একবার তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। সে বার তাঁর আর গঙ্গা স্নানে যাওয়া হয়নি। সেই রাতে স্বপ্ন দেখেন, তাঁর জন্য গঙ্গা উজানে বেয়ে এসে অজয়ে মিলিত হবেন। তাই সেই থেকে মকরসংক্রান্তির ভোরে গঙ্গা স্নানের পূণ্যলাভেরর বিশ্বাসে ভর করে মানুষের ঢল নামে ফি বছর বীরভূমের জয়দেব-কেঁদুলিতে। মেলা বসে জয়দেব মন্দিরটিকে ঘিরে। আউল-বাউল-ফকির-দরবেশের ভিড়ে সে মেলা কবি জয়দেবের কথায়, ‘দেশ-বিদেশ লোক যেন মহাগোল হৈল। সংকীর্তন কলরবে পৃথিবী পুরিল।।/ সাধুসন্ত তেজোবন্ত একত্র হৈল। অজয় কিনারে সবে আখড়া বাঁধিল।’
ঠিক একই দিনে দক্ষিণ ২৪ পরগনার কাকদ্বীপে মকরস্নানকে ঘিরে সাগরদ্বীপের দক্ষিণ প্রান্তে বসে সাগরমেলা। মূলত তিন দিনের এই মেলায় সংক্রান্তির আগের দিন বাউনির স্নান। সংক্রান্তির দিন মকর স্নান আর পয়লা মাঘ মাঘী স্নানের ঢল নামে। শুধু স্থান-কাল মাহাত্ম্যেই এ মেলা অনন্য। সাগর তটে সার সার হোগলার ছাউনি। সেখানেই হাজার হাজার মানুষের রাত-আখড়া। স্রেফ ধর্ম-বিশ্বাসে মানুষ ভিড় করেন? বোধহয় না। দু’টি মকর মেলারই নিজস্ব রোমাঞ্চ রয়েছে। ফি বছর তারই টানে দেশ-বিদেশের মানুষের ঢল নামে এই দুই মিলনমেলায়।
রামকিঙ্কর ও রবীন্দ্রনাথ
কলাভবনের পেন্টিং-এর ছাত্রী জয়া আপ্পাস্বামীর আদলেই ‘সুজাতা’ গড়েছিলেন রামকিঙ্কর। পরে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমারই ছাত্রী। ওর সঙ্গে আমার প্রেমের সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু ওর ফিগার ছিল খুব সুন্দর। লম্বা ছিপছিপে। মূর্তি গড়া শেষ হলে নাম দিলাম ‘জয়া’। কিঙ্করের মাস্টারমশাই নন্দলাল বসু ‘জয়া’ নাম বদলে রাখে ভাস্কর্যের নাম রাখলেন ‘সুজাতা’। আর এই ভাস্কর্যটি দেখেই রবিঠাকুর ডেকে পাঠিয়েছিলেন কিঙ্করকে। সেই শুরু কবির সঙ্গে কিঙ্করের ঘনিষ্ঠতার। দুই শিল্পীর সেই আলাপের তান-তোড় ও বিস্তার নিয়ে জয়দীপ মুখোপাধ্যায়ের গ্রন্থ ‘রামকিঙ্কর ও রবীন্দ্রনাথ’। দুই মানুষের জীবনের নানা পারস্পরিক ঘটনায় সাজানো এ বইয়ের পর্ব সাজানো ‘পটকথা’, ‘কবি ভাস্কর্যের ভুবন’, ‘অন্য রবি’-র মতো শীর্ষকে।
মেলায় পত্রিকা
কোথাও বা আপন খুশিতে এঁকে চলেছে খুদের দল, কোথাও বা গুরুগম্ভীর আলোচনাসভা— দু’দিন ধরে মেদিনীপুর জেলা পরিষদ চত্বর এমন ছবিই দেখল। সৌজন্যে, লিটল ম্যাগাজিন মেলা। আয়োজনে, মোদিনীপুর লিটল ম্যাগাজিন অ্যাকাডেমি। মেলার উদ্বোধন করেন সাহিত্যিক অমর মিত্র। ছিলেন সন্দীপ দত্তের মতো ব্যক্তিত্বও। পত্রিকা চালাতে গিয়ে কী কী অসুবিধে হচ্ছে, তা নিয়ে চর্চা করেন সম্পাদকেরা। লিটল ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদের হাল হকিকতের হদিস দেন শিল্পী রবি দে, মানব বন্দ্যোপাধ্যায়েরা। উদ্যোক্তারা জানান, ‘শ্রীজন’, ‘মহুল’, ‘অমিত্রাক্ষর’-সহ মোট দু’শোটি পত্রিকা মেলায় যোগ দেয়। সংবর্ধনা জানানো হয় হরিপদ মণ্ডল, অঞ্জন দাস-সহ বেশ কয়েকজন প্রাবন্ধিক ও কবিকে।
মঞ্চে বাক্য
ইচ্ছেটা ছিল ছেলেবেলা থেকেই। সেই মতো সলতে পাকানো শুরু করল বন্ধুরা। জিয়াগঞ্জের সুমন্ত দাস, শুভ সরকার, অমিত গোস্বামীর মঞ্চে প্রথম আত্মপ্রকাশ ২০১৩-তে। ওদের পোশাকি নাম ‘বাক্যব্যয়।’ তারপর থেকে প্রসেনিয়াম তো বটেই, সুমন্তরা পথ নাটিকাও করতে শুরু করল। ইতিমধ্যেই পরশুরামের গল্প অবলম্বনে ‘ভুষুণ্ডির মাঠ’, ‘অন্য রূপকথা’র মতো বেশ কয়েকটি নাটক দর্শকদের নজর কেড়েছে। নাটকের প্রয়োজনে আলমগঞ্জ, বীরভূমের প্রত্যন্ত গোবর্ধনডাঙা গ্রাম থেকে যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন— সব জায়গাতেই ছুটে চলেছে ‘বাক্যব্যয়।’ কী ভাবে চলছে এই নাট্যচর্চা? স্থায়ী কোনও মঞ্চ নেই। বন্ধুদের বাড়িতেই মহড়া চলছে। টাকা-পয়সা? সেটাও খসে নিজেদের পকেট থেকেই। আসলে মঞ্চের ওপারে আবছায়া মুখগুলোই যে ওদের সব।
সাধক কথা
খড়ের চালা, উঠোনে ছোট এক আমগাছ। হাত কয়েক দূরে ক্ষীণ ভাবে বয়ে চলেছে নেংসাই নদী। তার ঠিক পাশেই আমগাছের ছায়ায় মাদুর পেতে আধশোয়া অবস্থায় জীর্ণ খাতা নিয়ে সামনে বসে এক ঝুমুর পাগল। যাঁর খাতার পাতায় পাতায় কখনও রাঢ়বঙ্গের রুক্ষতা, কখনও অপরূপ নৈসর্গ ধরা পড়েছে। আবার খানিক পরেই গানের লাইন ধরে গুনগুন করে সুর ভাঁজছেন। মনের মতো সুর পেতেই একেবারে গলা ছেড়ে ধরলেন গান। এ ভাবেই একের পর এক ঝুমুর গান বেঁধেছিলেন সলাবত মাহাতো। ১৯৪২ সালে পুরুলিয়ার বরাবাজারের প্রত্যন্ত গ্রাম লটপদায় জন্ম। বৈষয়িক বাঁধন ছিড়ে গ্রামের প্রান্তে নদীর ধারে তাঁর বাস। সলাবতের কথায়, ‘তুমি যদি তাকে না ভালবাসবে/ সে তোমার কাছে আসবে কেন?’ এ যেন বাউলের গভীর তত্ত্বকথা। শয়নে স্বপনে আচরণে বাউল ভাবের প্রকাশ। অবশ্য বালক বেলাতেই তাঁর ঝুমুর গান শুনে স্কুলের শিক্ষকেরা বুঝেছিলেন, এ ছেলের অন্য মতি। প্রথাগত পুথিবিদ্যা এর জন্য নয়। আর কখনও পিছনে তাকাতে হয়নি। ঝুমুর গানের গায়কেরা সাধারণত প্রচলিত গান অথবা অন্য গীতিকারের লেখা গান আসরে পরিবেশন করে থাকেন। কিন্তু, প্রচলিত গান ছাড়াও নিজে ঝুমুর গান লিখে তাতে সুর দিয়ে গাইতে পারতেন সলাবত। মূলত দরবারি ঝুমুর গানের জন্যই তিনি বিখ্যাত ছিলেন। ১৯৯৬ সালে পেয়েছেন ‘আব্বাসউদ্দিন আহমেদ স্মৃতি পুরস্কার’ ও ‘চামু পুরস্কার’। ১৯৯৭ সালে পান ‘লালন স্মৃতি পুরস্কার’। জগত সংসারের অলিতে গলিতে ঝুমুর গানের সুর ছড়িয়ে দিয়ে গত শুক্রবার ভোরে জগতের মায়া কাটালেন চুয়াত্তরের সাধক সলাবত। খড় ও টালির চালার ঘরে ঝুলিতে পড়েই রইল শংসাপত্র। ঘরের কোণে একরাশ অভিমানে মুখ গুঁজে পড়ে রইল সাধের হারমোনিয়াম একতারা আর পায়ের ঘুঙুর।
খবরওয়ালা
পুরনো সাইকেলে চড়ে কচুবেড়িয়া ঘাট থেকে কপিলমুনির সাধনক্ষেত্র— ঘুরে ঘুরে খবর বের করেন তিনি। নিজের এলাকার মানুষের সুখদুঃখের খবর বিনা পারিশ্রমিকে ছোট-বড়-মাঝারি পত্রিকায় তুলে ধরাতেই তাঁর আনন্দ। নয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে এই কাজই করে চলেছেন ‘খবরওয়ালা’ অশোককুমার মণ্ডল। দক্ষিণ ২৪ পরগনার কাকদ্বীপ মহকুমা থেকে প্রকাশিত ‘সাগরসঙ্গম’ সংবাদ পাক্ষিকের সাম্মানিক সংবাদদাতা হিসেবে তাঁর হাতেখড়ি। প্রায় একই সময়ে ডায়মন্ড হারবারের ‘ফুটপাথ’ সংবাদ সাপ্তাহিকের সঙ্গে যোগাযোগ। মাঝে কলকাতা গণমাধ্যম কেন্দ্রে সাংবাদিকতার সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ নেন। দুই ২৪ পরগনা, পূর্ব মেদিনীপুর ও কলকাতার প্রায় ৩০টি পত্রপত্রিকায় তাঁর পাঠানো খবর প্রকাশিত হচ্ছে নিয়মিত। ‘সাগরের অশোক’ নামে পরিচিত ৫৯ বছরের এই লড়াকু ‘তরুণ’ সাদামাটা প্যান্ট-শার্ট, কাঁধে ঝোলাব্যাগ আর মুখে অনাবিল হাসি নিয়ে এখনও তাঁর ধাত্রীগ্রাম কয়লাপাড়া থেকে এলাকা চষে বেড়ান। কাকদ্বীপের মিঠাপান চাষের সমস্যা ও সম্ভাবনা থেকে পুরাতত্ত্ব, খেলাধুলো, সংস্কৃতি চর্চা বা এলাকার উন্নয়নের খবর— প্রায় দু’দশক ধরে সহজ ভাষায় লিখে চলেছেন সবই। এই তন্নিষ্ঠ প্রয়াসের স্বীকৃতিস্বরূপ এলাকায় ও ভিন্ মহকুমা থেকে বহু পুরস্কার ও সম্মানও পেয়েছেন।