কাগজে-কলমে আত্মসমর্পণ না হলেও কার্যত সে রকমই পরিস্থিতি তৈরি করে দিয়েছিলেন নেতাই-কাণ্ডে ধৃত সিপিএম নেতাদের একাংশ। দীর্ঘ দিন বাড়ির লোককে কাছে না পেয়ে ওই পরিবারের লোকেরাই যে নানা মাধ্যমে পলাতকদের মোবাইল নম্বর পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিলেন, তা জানাচ্ছেন পুলিশেরই একাধিক সূত্র। সেই কারণে নেতাই-কাণ্ডে অভিযুক্ত পাঁচ সিপিএম নেতাকে হায়দরাবাদ থেকে ধরে আনতে সিআইডিকে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি বলে মনে করছেন রাজ্য প্রশাসনের কর্তারা।
পুলিশ, সিপিএম এবং স্থানীয় সূত্র জানাচ্ছে, পশ্চিম মেদিনীপুরের এসপি থাকাকালীনই ভারতী ঘোষ নেতাইয়ের ফেরার সিপিএম নেতাদের ধরতে সক্রিয় হয়েছিলেন। বেশ কয়েক দফা কথাবার্তার পরে দু-একটি পরিবার তাঁদের বাড়ির লোকের সঙ্গে পুলিশের যোগাযোগ করতে রাজি হয়ে যান। ইতিমধ্যে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে বদলি হতে হয় ভারতীদেবীকে। তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া সিআইডিতে। কিন্তু বদলি হয়েও পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলা পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন করেননি ভারতীদেবী। এমনকী, সিপিএমের নেতাদের ধরতে যে পুলিশকর্মীদের নিয়ে তিনি হায়দরাবাদে গিয়েছিলেন, তাঁদের অধিকাংশই পশ্চিম মেদিনীপুরের। নবান্ন সূত্রের খবর, ওই পরিকল্পনার কথা পুলিশ-প্রশাসনের হাতে গোনা দু-এক জন শীর্ষকর্তা ছাড়া কেউই জানতেন না।
মঙ্গলবার বেলা দেড়টা নাগাদ মেদিনীপুর আদালতে নিয়ে আসা হয় ডালিমদের। এজলাসের লক-আপে ফুরফুরে মেজাজেই ছিলেন তিনি। পরিচিতদের দেখে হেসেছেন। হাসিমুখেই আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলেছেন। বাকিরাও যে খুব একটা গম্ভীর ছিলেন, তা-ও নয়।
সিপিএম সূত্রের খবর, একের পর এক আশ্রয় বদলাতে বদলাতে ধৃত পাঁচ জনের প্রায় সকলেই অধৈর্য হয়ে পড়েছিলেন। গত তিন বছর তিন মাস ধরে তাঁরা ওড়িশা, কেরল, পঞ্জাব ও হরিয়ানায় অনিশ্চিত জীবন যাপন করেছেন। ধীরে ধীরে দলীয় নেতৃত্বের উপরে আস্থা হারাচ্ছিলেন কয়েক জন। দলীয় সূত্র জানাচ্ছে, অজ্ঞাতবাসের সময়েই বড় অসুখে পড়েন জয়দেব গিরি, খলিলউদ্দিন ও তপন দে। এই পরিস্থিতিতে ফেরারদের একাংশ একাধিক বার আত্মসমর্পণ করতে চাইলেও জেলা নেতৃত্ব তাঁদের বাধা দিয়েছেন বলে সিপিএম সূত্রের খবর।
দলীয় সূত্র জানাচ্ছে, পলাতক নেতাদের মামলার খরচ মেটাতে প্রয়োজনে জমি বেচে অর্থ জোগানো হবে বলে জেলা সিপিএমের কয়েক জন নেতা ওই পরিবারগুলোকে আশ্বাস দিয়েছিলেন। পশ্চিম মেদিনীপুরে সিপিএমের জেলা সম্পাদক দীপক সরকার অবশ্য এ দিন বলেন, “জমি বেচে মামলার খরচ জোগাতে হবে, দলের এতটা দুরবস্থা এখনও হয়নি।” কিন্তু
ভোটের ঠিক আগে (পশ্চিম মেদিনীপুরে ৭ মে ভোট) এই গ্রেফতারি যে নেতাই-কাণ্ডের স্মৃতি নতুন করে উস্কে দিল এবং তার জেরে জঙ্গলমহলে তাঁদের রাজনৈতিক জমি আরও নড়বড়ে হল, তা মেনে নিচ্ছেন জেলার সিপিএম নেতাদের একাংশ। কারণ ধৃতদের মধ্যে দু’জন দলের লোকাল কমিটির সম্পাদক, এক জন জেলা কমিটির সদস্য ও এক জন লোকাল কমিটির প্রাক্তন সম্পাদক। রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য বলছেন, “লোকসভা ভোটে নেতাই-কাণ্ড তেমন প্রাসঙ্গিক ছিল না। কিন্তু ভোটের মুখে এর প্রতিকূল প্রভাব ঠেকানো মুশকিল।”
তা হলে গোড়াতেই কি দলীয় নেতৃত্ব ওঁদের আত্মসমপর্ণের পরামর্শ দিতে পারত না? সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য গৌতম দেবের বক্তব্য, “পুলিশকে সব মামলায় সহযোগিতা করতে হবে, রাজনীতিতে এমন কোনও কথা নেই। যা হয়েছে, তা রাজনীতিরই অঙ্গ।”