নিজের ঘরেই ‘ঘোঘের বাসা’ ভাঙতে চাইছেন তিনি।
নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের দায়িত্ব পেয়ে তাই বিভিন্ন গেস্ট হাউসের হাল হকিকত সম্পর্কে খোঁজ নিতে শুরু করেছিলেন বাবুল সুপ্রিয়। তখনই নজরে পড়েছিল, নিজাম প্যালেসে কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের গেস্ট হাউসে প্রায় পাঁচ বছর ধরে পাঁচটি ঘর দখল করে রেখেছেন তৃণমূলের চার সাংসদ মুকুল রায়, তাপস পাল, সৃঞ্জয় বসু এবং সৌগত রায়।
কিছু দিন আগেই দলবদল করে রাজ্যের শাসকদলে সদ্য নাম লিখিয়েছেন মুর্শিদাবাদের প্রাক্তন কংগ্রেস সাংসদ মান্নান হোসেন। নিজাম প্যালেসে তাঁর প্রশস্ত ঘরটিও হাত ঘুরে এখন এক দলীয় সাংসদের আপ্ত সহায়কের মৌরসি পাট্টা।
ঘটনা হল, ওই পাঁচ ঘরের একটিতেই সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেনের সঙ্গে তৃণমূলের শীর্ষ নেতাদের গোপন বৈঠক হয়েছিল বলে ইতিমধ্যে জানতে পেরেছে সিবিআই। সারদা-কর্তাকে চাপ দিয়ে টাকা আদায় এবং ষড়যন্ত্রের অভিযোগে গ্রেফতারও হয়েছেন সৃঞ্জয়। আপাতত তিনি সিবিআই হেফাজতে। ‘ঘরে ছেলে ঢুকিয়ে রেপ করিয়ে দেব’ বলার পরে ‘চন্দননগরের মাল’ তাপস পালের বিরুদ্ধে সিআইডি তদন্ত শুরু হয়েছে, যদিও তিনি এখনও গ্রেফতার হননি।
ঘটনাচক্রে, কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন প্রতিমন্ত্রীর কলকাতা অফিসও ওই নিজাম প্যালেসে। সহজবোধ্য কারণেই সেখানে তৃণমূলের ‘ডেরা’ পছন্দ নয় বাবুলের। তবে সরকারি ভাবে তৃণমূল নেতাদের ঘর ছাড়ার চিঠি তিনি এখনও ধরাননি। সেই প্রশ্ন এড়িয়ে তাঁর বার্তা, “ওই সব ঘরে নিয়মভঙ্গের বিবিধ অভিযোগই তো রয়েছে। আশা করছি, এ বার নিজেরাই ওঁরা ঘর খালি করে দেবেন।” এ ব্যাপারে তৃণমূলের ওই সাংসদদের সঙ্গে নিজেই কথা বলেছেন বাবুল। কিন্তু মন্ত্রীর সে অনুরোধে সাড়া মিলবে তো? বাবুল বলছেন, “ওঁরা সাংবিধানিক পদে রয়েছেন। এটুকু প্রত্যাশা ওঁদের কাছে করাই যায়।”
লোকসভা নির্বাচনের পরে রাজ্যে বামেরা দুর্বল হয়ে যাওয়ায় প্রধান বিরোধী দল হিসেবে উত্থান হচ্ছে বিজেপির। ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনে তারা রাজ্যে ক্ষমতা দখল করতে পারে বলেও স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন নেতাকর্মীদের একটা বড় অংশ। স্বাভাবিক ভাবেই, তৃণমূলের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য হয়েছেন বিজেপি নেতারাই। সম্প্রতি নবান্নে গিয়ে বাবুল রাজ্যের নগরোন্নয়মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম এবং দফতরের কর্তাদের সঙ্গে দেখা করতে চাইলেও তাঁদের কেউ কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে সময়ই দিতে চাননি। দিল্লিতে গানের অনুষ্ঠান নিয়ে বাবুলের নিমন্ত্রণে সাড়া দিয়েছেন বটে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু এই ‘সৌজন্য’ কতটা বজায় থাকবে, তা নিয়ে দুই শিবিরই যথেষ্ট সন্দিহান। তৃণমূল নেতাদের নিজাম প্যালেসে ঘর খালি করে দিতে বলা কি আসলে সেই মার-পাল্টা মারেরই ধারা মেনে?
বাবুলের দাবি, তিনি ‘প্রতিহিংসার রাজনীতি’তে বিশ্বাস করেন না। তাঁর যুক্তি, “নিজাম প্যালেসে তৃণমূল সাংসদদের দখল করা ওই ঘরগুলিতে বিভিন্ন ধংসাত্মক কাজকর্ম হচ্ছে বলে ধারাবাহিক ভাবে অভিযোগ উঠছে। সে কারণেই ঘর ছাড়তে বলা হয়েছে।” এই বার্তা অবশ্য নতুন নয়। বিগত ইউপিএ জমানাতেও ওই চার সাংসদকে ঘর ছাড়ার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়েছিলেন তৎকালীন নগরোন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী দীপা দাশমুন্সি। তিনি বলেন, “দু’বার চিঠি দেওয়া হয়েছিল। ঘর ছাড়া দূরের কথা, ওঁরা উত্তর দেওয়ার সৌজন্যও দেখাননি।” তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতা অবশ্য দাবি করেন, সে বার তেমন কোনও চিঠিই সাংসদেরা হাতে পাননি।
নিজাম প্যালেসের সরকারি গেস্ট হাউসটি নগরোন্নয়ন দফতরের এস্টেট ম্যানেজারের এক্তিয়ারে। তবে গেস্ট হাউসের তিনটি ‘উইং’-এ ৫২টি স্যুইটের দেখভালের দায়িত্ব কেন্দ্রীয় পূর্ত মন্ত্রকের (সিপিডব্লুডি)। তাদের নজরদারিতেই দেড় বছর ধরে সেখানে সংস্কারের কাজ চলেছে। কিন্তু চার সাংসদ স্যুইট না ছাড়ায় ওই ‘উইং’-এর দোতলা-তিন তলার সংস্কার থমকে রয়েছে বলে সিপিডব্লুডি সূত্রের খবর।
সৃঞ্জয় এখন বিচার বিভাগীয় হেফাজতে। তাপস পাল ফোন ধরেননি। মুকুল রায় বা সৌগত রায় এই বিষয়ে কিছু বলতে চাননি। তবে তৃণমূলের এক তাবড় সাংসদের দাবি, “নিয়ম নীতি মেনেই ওই ঘরগুলিতে রয়েছেন সাংসদেরা। নিয়ম ভাঙার প্রশ্ন নেই।” পূর্ত মন্ত্রকের এক পদস্থ কর্তা অবশ্য জানান, এক টানা পাঁচ দিনের বেশি ওই স্যুইটগুলি ভাড়া নেওয়া যায় না। তা হলে, পাঁচ বছর ধরে তৃণমূল সাংসদেরা রয়েছেন কী করে?
মুচকি হেসে কর্তার জবাব, “নিয়ম ভাঙাই এখন নিয়ম বলে মনে করছেন শাসকদলের সাংসদেরা।”