নেতাই-কাণ্ডে ধৃতদের কোর্টে তোলার সময় তাণ্ডব তৃণমূলের

আদালতে ঢোকার মুখে আক্রান্ত হলেন নেতাই-কাণ্ডে ধৃত পাঁচ সিপিএম নেতা-কর্মী। পুলিশের একটি গাড়িতে করে বুধবার দুপুর দেড়টা নাগাদ তাঁদের ঝাড়গ্রাম মহকুমা আদালতে নিয়ে আসা হচ্ছিল। সে সময় তৃণমূলের কিছু কর্মী সমর্থক গাড়ির জানলা দিয়ে লাঠি ঢুকিয়ে তাঁদের আঘাত করেন। তাঁদের গায়ে থুতুও ছেটানো হয়। মারধর করা হয়েছে আদালত প্রাঙ্গণে উপস্থিত সিপিএমের অন্য নেতাকর্মীদেরও। প্রহৃত হয়েছেন নেতাই কাণ্ডে অভিযুক্তদের পরিবারের লোকজনেরাও। তৃণমূল কর্মীদের তখন থামাতে গিয়ে লাঠির ঘায়ে আহত হন সিআইডি-র ইন্সপেক্টর অরুণাভ দাসও।

Advertisement

কিংশুক গুপ্ত

ঝাড়গ্রাম শেষ আপডেট: ০১ মে ২০১৪ ০৪:৪৭
Share:

নেতাই কাণ্ডে অভিযুক্ত ডালিম পাণ্ডের খুড়তুতো ভাইকে মার তৃণমূল কর্মীর। বুধবার দেবরাজ ঘোষের তোলা ছবি।

আদালতে ঢোকার মুখে আক্রান্ত হলেন নেতাই-কাণ্ডে ধৃত পাঁচ সিপিএম নেতা-কর্মী। পুলিশের একটি গাড়িতে করে বুধবার দুপুর দেড়টা নাগাদ তাঁদের ঝাড়গ্রাম মহকুমা আদালতে নিয়ে আসা হচ্ছিল। সে সময় তৃণমূলের কিছু কর্মী সমর্থক গাড়ির জানলা দিয়ে লাঠি ঢুকিয়ে তাঁদের আঘাত করেন। তাঁদের গায়ে থুতুও ছেটানো হয়। মারধর করা হয়েছে আদালত প্রাঙ্গণে উপস্থিত সিপিএমের অন্য নেতাকর্মীদেরও। প্রহৃত হয়েছেন নেতাই কাণ্ডে অভিযুক্তদের পরিবারের লোকজনেরাও। তৃণমূল কর্মীদের তখন থামাতে গিয়ে লাঠির ঘায়ে আহত হন সিআইডি-র ইন্সপেক্টর অরুণাভ দাসও।

Advertisement

লালগড় এলাকার তৃণমূল নেতা-কর্মীরাই এ দিনের ঘটনায় নেতৃত্ব দেন। ঘটনার কথা স্বীকারও করেছেন তৃণমূল নেতারা। লালগড় ব্লক তৃণমূল সভাপতি বনবিহারী রায় বলেন, “আইন আইনের পথে চলবে। সেখানে এই ভাবে অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ মোটেই কাম্য নয়। এ দিন আদালত প্রাঙ্গণে যা ঘটেছে, তা অত্যন্ত লজ্জাজনক।” সিআইডি-র অরুণাভবাবুর কাছ থেকে তৃণমূল নেতারা পরে ক্ষমাও চেয়ে নিয়েছেন। তবে লালগড় ব্লক যুব তৃণমূলের সহ সভাপতি জলধর পণ্ডা বলেন, “নেতাই কাণ্ডে সিপিএম যে ভাবে ৯ জন গ্রামবাসীকে খুন করেছিল, সেই ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এদিন।” তবে তাঁরও বক্তব্য, “আমরা বিক্ষোভ দেখাতে গিয়েছিলাম, এমন ঘটনা ঘটে যাবে ভাবতে পারিনি।”

অভিযোগ, প্রায় আধঘন্টা ধরে এই তাণ্ডব চলার সময়ে পুলিশ ছিল নীরব দর্শক। এ দিন ‘সিবিআই মুর্দাবাদ, সিআইডি জিন্দাবাদ’ স্লোগান তুলে ঝাড়গ্রাম মহকুমা আদালত প্রাঙ্গণে লাঠি হাতে দাপিয়েও বেড়ান তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা। এই ঘটনার পরে আদালত প্রাঙ্গণের নিরাপত্তার অভাব নিয়ে বিচারকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন সিবিআইয়ের আইনজীবী পার্থ তপস্বী। পার্থবাবু বিচারককে জানান, এদিন শাসক দলের লোকেরা আদালত প্রাঙ্গণে সিবিআই সম্পর্কে কটূক্তি ও অশ্লীল গালিগালাজ করেছেন। এর প্রেক্ষিতেই অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়।

Advertisement

এ দিন বেলা বারোটা নাগাদ সিআইডি-র অফিসারেরা ভবানীভবন থেকে নেতাই কাণ্ডে অভিযুক্ত ডালিম পাণ্ডে-সহ পাঁচ জনকে একটি প্রিজন ভ্যানে করে প্রথমে মহকুমা শাসকের দফতরের মধ্যেই ঝাড়গ্রাম পুলিশ কোর্টে নিয়ে আসেন। সেখান থেকে দেড়টা নাগাদ অভিযুক্তদের ঝাড়গ্রাম এসিজেএম আদালতে নিয়ে যাওয়ার সময় বাধা দেন তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা। তাঁদের মধ্যে ছিলেন জলধরবাবু, পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়নমন্ত্রী সুকুমার হাঁসদার দলীয় আপ্ত সহায়ক দশরথ হেমব্রম এবং ঝাড়গ্রাম শহরের কিছু তৃণমূল কর্মী। এসডিও অফিসের দরজার সামনেই পুলিশের গাড়িটিকে আটকে দেন তাঁরা।

সে সময়েই ‘সিবিআই মুর্দাবাদ, সিআইডি জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিতে থাকেন বিক্ষোভকারীরা। সিআইডি-র অফিসারদের হস্তক্ষেপে কোনও মতে বিক্ষোভকারীদের সরিয়ে দিয়ে ভ্যানটি ঝাড়গ্রাম আদালতের দিকে রওনা দেয়। তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা তখনও ভ্যানটির সামনে স্লোগান দিতে দিতে হাঁটতে থাকেন। আদালতের মূল দরজার সামনে আরও বেশ কিছু তৃণমূল নেতাকর্মী প্ল্যাকার্ড নিয়ে অপেক্ষায় ছিলেন। প্রাঙ্গণে ঢোকার সময় গাড়ির গায়ে অবিরাম লাঠিপেটা করতে থাকেন তৃণমূলের লোকজন। তখনই ভ্যানের জাফরির ফোকর দিয়ে লাঠি ঢুকিয়ে অভিযুক্তদের খোঁচাতে থাকেন তৃণমূল কর্মীরা। সেই সময়ে থুতুও ছেটানো হয়।

কয়েকজন পুলিশ কর্মী কোনও মতে প্রিজন ভ্যানটিকে আদালত প্রাঙ্গণে ঢুকিয়ে দেন। কিন্তু জলধরবাবুর নেতৃত্বে কয়েকশো তৃণমূল কর্মীও রে-রে করে আদালত প্রাঙ্গণে ঢুকে পড়েন। ডালিমবাবুদের এসিজেএম কোর্ট লক-আপে ঢুকিয়ে দেয় পুলিশ।

এরপর আদালত প্রাঙ্গণে ডালিমবাবুদের দেখতে আসা সিপিএমের লোকজন ও অভিযুক্তদের পরিজনদের লাঠিপেটা শুরু করেন তৃণমূল কর্মীরা। ঝাড়গ্রাম শহর সিপিএমের ২ নম্বর লোকাল কমিটির সদস্য শ্যামল সনগিরিকে মারধর করা হয়। সিপিএম নেতা শ্যামলবাবুকে বাঁচাতে গিয়ে লাঠির ঘায়ে মাথা ফেটে যায় শহরের তৃণমূল কর্মী নির্মল দাসেরও। তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা চিৎকার করে বলতে থাকেন, “ডালিম পাণ্ডেদের আমাদের হাতে তুলে দিন। ওই খুনি-হার্মাদদের আমরাই গণ আদালতে বিচার করব।”

ডালিমবাবুর খুড়তুতো ভাই দেবাশিস পাণ্ডে আদালত প্রাঙ্গণের গাছ তলায় বসেছিলেন। তৃণমূলের কর্মীরা তাঁর উপরেও চড়াও হন। দেবাশিসবাবুকে চড়-থাপ্পড় মেরে লাঠিপেটা করে আদালত প্রাঙ্গণ ছেড়ে যাওয়ার ফতোয়া দেন তৃণমূলের লোকজন। দেবাশিসবাবু বাইকে চেপে পালানোর সময়ও তাঁকে বেধড়ক লাঠিপেটা করা হয়। আদালত প্রাঙ্গণে দলীয় কর্মীদের এ ধরনের আচরণের প্রতিবাদ করেন শহর তৃণমূলের সভাপতি তথা বরিষ্ঠ আইনজীবী প্রশান্ত রায়। কিন্তু জলধরবাবুরা নিরস্ত হননি। উল্টে প্রশান্তবাবুর সঙ্গে বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়েন তৃণমূল কর্মীরা। দলীয় কর্মীদের উগ্রমূর্তি দেখে আদালতের ভিতর ঢুকে পড়েন প্রশান্তবাবু। খবর পেয়ে এসডিপিও (ঝাড়গ্রাম) বিবেক বর্মা ও ঝাড়গ্রাম থানার আইসি তানাজি দাস আদালত প্রাঙ্গণে এসে পরিস্থিতি সামাল দেন।

সিপিএমের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা কমিটির সদস্য প্রদীপ সরকারের বক্তব্য, “পুলিশের চোখের সামনে আদালত প্রাঙ্গণেই কী করে এই ধরনের কাণ্ড ঘটল, তা ভাবতেও পারছি না।” ঝাড়গ্রামের পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়া বলেন, “আদালত প্রাঙ্গণে যথেষ্টই পুলিশ ছিল। তবে বিক্ষোভকারীরা সংখ্যায় বেশি থাকায় বাড়তি পুলিশ পাঠিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হয়।”

বেলা দু’টোর পরে এসিজেএম আদালতের বিচারক কৃষ্ণমুরারিপ্রসাদ গুপ্তর এজলাসে ধৃতদের হাজির করায় সিআইডি। অভিযুক্তদের নিজেদের হেফাজতে নেওয়ার আবেদন জানায় সিবিআই। তা খারিজ করে দিয়ে পাঁচ অভিযুক্তকে পাঁচ দিন জেল হাজতে রাখার নির্দেশ দেন বিচারক।

তবে এই সময়ের মধ্যে সিবিআই ৫ অভিযুক্তকেই জেরা করতে পারবে। নেতাইকাণ্ডের তদন্তভার সিআইডি-র কাছ থেকে সিবিআইয়েরই হাতে চলে গিয়েছে। তবে ২৮ এপ্রিল সোমবার হায়দরাবাদের চিক্কাডাপল্লি থেকে এই পাঁচল জনকে গ্রেফতার করেছে সিআইডি-ই। অভিযুক্ত পক্ষের আইনজীবী এ দিন দাবি করেন, “তদন্তের কোনও এক্তিয়ারই নেই সিআইডি-র। তবু ওরা নেতাই মামলায় নাক গলাচ্ছে।”

সিবিআইয়ের আইনজীবী পার্থবাবু জানান, “এই মামলায় ফেরার অভিযুক্তদের সম্পর্কে আমরা বেশ কয়েকবারই রাজ্য গোয়েন্দা পুলিশের সঙ্গে তথ্য আদানপ্রদান করেছি। তারই ভিত্তিতে এই পাঁচ জনকে সিআইডি গ্রেফতার করেছে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন