যন্ত্রনির্ভর পণ্য খালাসে অদক্ষতার অভিযোগ আগেই ছিল। সঙ্গে এ বার সঙ্গে যোগ হল নাব্যতার সমস্যা। তার জেরে হলদিয়া ছেড়ে ওড়িশার ধামড়া ও পারাদ্বীপ বন্দরে পণ্যবাহী জাহাজ সরিয়ে নিয়ে যাওয়া শুরু করেছে বিভিন্ন আমদানিকারী সংস্থা। ইতিমধ্যেই দু’টি সংস্থা বন্দর কর্তৃপক্ষকে লিখিত ভাবে জানিয়েছে, হলদিয়া বন্দর দিয়ে পণ্য সরবরাহে তারা অপারগ। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে অচিরেই হলদিয়া বন্দর সঙ্কটে পড়বে বলে আশঙ্কা করছে জাহাজি মহল।
কলকাতা বন্দর কর্তৃপক্ষের দাবি, হলদিয়ায় এখন নাব্যতা ৬.৯ মিটার। জলের গভীরতা এবং জোয়ারের সময় জলস্ফীতির উপরে নাব্যতা নির্ভর করে। হুগলি নদীতে পলি জমায় হলদিয়া ও কলকাতা বন্দর দীর্ঘ দিন ধরেই নাব্যতার সঙ্কটে ভুগছে। বন্দরের মেরিন বিভাগের এক কর্তা জানান, আগে গড়ে ৮ মিটার পর্যন্ত নাব্যতায় হলদিয়া বন্দরে জাহাজ আসত। কিন্তু ২০০৮ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৭ থেকে ৭.৩ মিটার। তার পরে কয়েক বছর ধরে ওই নাব্যতাই বজায় ছিল। কিন্তু এখন তা আরও ০.৪ মিটার কমে গিয়ে সমস্যা তৈরি হয়েছে। সেই কারণেই বিভিন্ন সংস্থা হলদিয়া বন্দরে পণ্য খালাসে আগ্রহ হারাচ্ছে। উল্টো দিকে ওড়িশার ধামড়া ও পারাদ্বীপে নাব্যতা বছরভরই ১০ মিটারের বেশি থাকে।
পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন কলকাতা বন্দর কর্তৃপক্ষও। চেয়ারম্যান রাজপাল সিংহ কাঁহালো বলেন, “বেশ চিন্তায় রয়েছি। হঠাৎই নাব্যতা কিছুটা কমে গিয়েছে। নদীর গতি-প্রকৃতি তো আমাদের হাতে নেই। তবে এ’জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।” কী কারণে নাব্যতা এতটা কমে গিয়েছে? বন্দর চেয়ারম্যানের ব্যাখ্যা, “হুগলি নদীর পূর্ব পাড়ের চরিত্র বেশ বিচিত্র। এ বার ফলতার কাছ থেকে বালি ও পলির স্তর এমন ভাবে ওলোটপালোট হয়েছে যে, তার জেরে নদী নাব্যতা হারিয়েছে। প্রাকৃতিক এই পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য সব চেষ্টা করা হচ্ছে। ড্রেজিং হচ্ছে, বিদেশি বিশেষজ্ঞ এনে পরামর্শও নেওয়া হচ্ছে। আশা করি, এই অবস্থা বেশি দিন স্থায়ী হবে না।”
বন্দর সূত্রের খবর, ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কর্পোরেশন (এনটিপিসি) ইন্দোনেশিয়া থেকে কয়লা আমদানি করে হলদিয়া বন্দর দিয়ে। ফরাক্কা এবং কাহেলগাঁও বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য তারা বছরে ১৫ থেকে ২০ লক্ষ টন কয়লা আমদানি করে হলদিয়া দিয়ে। কিন্তু এনটিপিসি-র হয়ে বরাত পাওয়া আমদানিকারী সংস্থা আদানি গোষ্ঠী গত শুক্রবার বন্দর কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিয়েছে, এখন থেকে তারা হলদিয়া বন্দরে আর কয়লার জাহাজ ভেড়াবে না। এনটিপিসি-র জন্য আনা কয়লার একটি জাহাজ যে তারা এ দিনই হলদিয়ার বদলে পারাদ্বীপে নিয়ে গিয়েছে, তা-ও জানিয়েছে সংস্থাটি। তাদের যুক্তি, চুক্তি অনুযায়ী জুলাইয়ের মধ্যে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কয়লা পৌঁছে দিতে হবে। হলদিয়ায় নাব্যতার যা হাল, তাতে নির্দিষ্ট সময়ে তারা সেই লক্ষ্যপূরণ করতে পারবে না।
আরও একটি সংস্থাও বন্দর কর্তৃপক্ষকে এর আগে একই কথা জানিয়ে চিঠি দিয়েছে। টাটা গোষ্ঠীর হুগলি-মেটকোক কারখানাও বিদেশ থেকে কয়লা আমদানি করে হলদিয়া বন্দর দিয়ে। সংস্থার জেনারেল ম্যানেজার শৈলেশ বর্মা গত ৬ মার্চ বন্দর-কর্তাদের চিঠি দিয়ে বলেছেন, নাব্যতা ৯ মিটারের কাছাকাছি ফিরিয়ে আনতে না পারলে হলদিয়ায় তাঁদের কারখানাই হয়তো বন্ধ করে দিতে হবে। বন্দর কর্তৃপক্ষকে তিনি লিখেছেন, টাটা গোষ্ঠী যখন হলদিয়ায় কারখানা চালুর পরিকল্পনা করে, তখন বন্দরের নাব্যতা ছিল প্রায় ৯ মিটার। পরিকল্পনা ছিল এই বন্দর দিয়ে বছরে ১০ লক্ষ টন কয়লা আনা হবে। কিন্তু ২০০৯ সালে কারখানা যখন চালু হয়, তখন হলদিয়ায় নাব্যতা কমে দাঁড়ায় ৭ মিটারের কাছাকাছি। ফলে বড় জাহাজ আনা বন্ধ হয়ে যায়। বাধ্য হয়ে টাটা গোষ্ঠী কয়লা আনার জন্য পারাদ্বীপ ও ধামড়া বন্দরের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। টাটা-কর্তার দাবি, হলদিয়ার পরিবর্তে ওড়িশায় পণ্য নামিয়ে রেলপথে তা হলদিয়ায় আনতে বছরে তাদের বাড়তি ৩০ কোটি খরচ হচ্ছে। বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে নাব্যতা ফেরানোর অনুরোধ করে টাটা গোষ্ঠীর একমাত্র মেটালার্জিক্যাল কোক কারখানার এই কর্তা বলেছেন, বন্দরে নাব্যতা না-ফিরলে হলদিয়ায় তাঁদের কারখানা চালু রাখাই কঠিন হবে।
অন্য বন্দরে জাহাজ চলে যাওয়ার ঘটনা নিয়েও উদ্বেগে রয়েছেন বন্দরের চেয়ারম্যান কাঁহালো। তিনি বলেন, “এনটিপিসি যে পারাদ্বীপ ও ধামড়া থেকে জাহাজে কয়লা নামাবে, তা আমাদের জানা ছিল। সেই কাজ শুরু হয়েছে। অন্যান্য সংস্থার সঙ্গেও আমাদের আলোচনা চালাতে হবে। হলদিয়ায় যারা জাহাজ আনে, তারা যাতে অন্যত্র চলে না যায়, তার জন্যও বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি নাব্যতা বাড়ানোর প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে।”