রেলে যাত্রী-নিরাপত্তার বেহাল দশার ছবিটা নতুন নয়! তা নিয়ে প্রশ্নও ওঠে বারবার। রেল পুলিশের কর্তারা প্রতিবারই আশ্বাস দেন, নিরাপত্তা বাড়ানো হবে। কিন্তু কথা থেকে যায় কথাতেই। ছবিটা বদলায় না! রেলে নিরাপত্তার যে কী করুণ অবস্থা, তার সর্বশেষ উদাহরণ বৃহস্পতিবার রাতে লোকাল ট্রেনে এক ছাত্রীর আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা।
নিত্যযাত্রীরা বলছেন, শুধু নিরাপত্তাই নয়, রেল পুলিশের আওতায় আইনশৃঙ্খলার অবস্থাও তথৈবচ। ছাত্রীর আক্রান্ত হওয়ার ঘটনার পরে ৪৮ ঘণ্টা কেটে গেলেও অভিযুক্তকে ধরতে পারেনি দমদম জিআরপি। তদন্ত করতে গিয়ে কার্যত অন্ধকারেই তাঁরা।
কী হয়েছিল ওই ছাত্রীর? দুর্গানগরের বাসিন্দা শুচিস্মিতা দাস বেথুন কলেজে পড়েন। বৃহস্পতিবার রাতে শিয়ালদহমুখী দত্তপুকুর লোকালে উল্টোডাঙা যাচ্ছিলেন তিনি। দমদম স্টেশন ছাড়ার পরে চলন্ত ট্রেনের মধ্যেই ছিনতাইবাজের কবলে পড়েন শুচিস্মিতা। অভিযোগ, মহিলা-কামরায় উঠে ওই ছাত্রীকে মারধর করে মোবাইল ছিনিয়ে নেয় এক দুষ্কৃতী। বাধা দিতে গেলে শুচিস্মিতার মাথায় চপারের কোপও মারে সে।
ছাত্রীর পরিবারের অভিযোগ, আহত অবস্থায় ওই ছাত্রী উল্টোডাঙা স্টেশনে নামার পরেও দেখা পাওয়া যায়নি কোনও পুলিশকর্মীর। পরে অবশ্য নার্সিংহোম থেকে খবর পেয়ে দমদম জিআরপি-র অফিসারেরা ওই ছাত্রীর সঙ্গে কথা বলেন। ওই ছাত্রীর বাবা শুক্রবার দমদম জিআরপি-র কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। আহত অবস্থায় ওই ছাত্রী এখন উল্টোডাঙায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে রয়েছেন। পুলিশ জানিয়েছে, ওই ছাত্রীর দেওয়া বর্ণনা অনুযায়ী দুষ্কৃতীর স্কেচ আঁকানো হচ্ছে।
নিত্যযাত্রীদের অভিযোগ, শিয়ালদহের বনগাঁ ও মেন শাখায় ছিনতাই এখন প্রায় রোজকার ঘটনা। বিধাননগর স্টেশন এবং দমদমে বড় ধরনের একটি দুষ্কৃতী-চক্র রয়েছে। তারা প্রায়ই যাত্রীদের মোবাইল, মানিব্যাগ ছিনতাই করছে বা পকেট থেকে তুলে নিচ্ছে। অভিযোগ, জিআরপি সব জেনেশুনেও সেই দুষ্কৃতীদের ধরার ক্ষেত্রে কখনও সচেষ্ট হয় না। গত এক বছরে জিআরপি-র বিরুদ্ধে লাগাতার এই অভিযোগ উঠেছে। কখনও আবার খোদ শিয়ালদহ স্টেশনেই তোলাবাজি ও অপহরণের অভিযোগ উঠেছে রেল পুলিশের স্পেশাল অপারেশন গ্রুপের বিরুদ্ধে। চিৎপুর ইয়ার্ডে এক মহিলাকে লাগাতার ধর্ষণ করা হলেও রেল পুলিশ তা আটকাতে সচেষ্ট হয়নি। ১১ জানুুয়ারি দমদম ক্যান্টনমেন্টের কাছে রেললাইনের ধারে বিস্ফোরণে আহত হয় দুই কিশোর। সেই ঘটনারও তল খুঁজে পায়নি জিআরপি।
রেল সূত্রের খবর, রাতে প্রতিটি লোকাল ট্রেনের মহিলা-কামরায় জিআরপি বা আরপিএফ-এর দু’জন করে রক্ষীর থাকার কথা। কিন্তু পুলিশকর্মীর সংখ্যা কম হওয়ায় সব ট্রেনের মহিলা-কামরায় নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব হয় না। এই অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, ট্রেনযাত্রীদের নিরাপত্তাই যদি নিশ্চিত করা না যায়, তা হলে রেল পুলিশ রেখে লাভ কী?
অতীতে দেখা গিয়েছে, অভিযোগ উঠলেই রেল পুলিশের কর্তারা নিজেদের দুর্বল পরিকাঠামোর যুক্তি দেন। এ বারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। শুচিস্মিতার আক্রান্ত হওয়ার ঘটনার পরেও শিয়ালদহের রেল পুলিশ সুপার দেবাশিস বেজ বলছেন, “পুলিশকর্মীর সংখ্যা কম, তাই সব মহিলা-কামরায় সুরক্ষা দেওয়া যায় না।” নিত্যযাত্রীরা বলছেন, দমদম-বিধাননগরের মতো শিয়ালদহ শাখার বিভিন্ন বড় স্টেশনে হকারদের কাছ থেকে ‘আদায়’ কিংবা মহিলা-কামরায় ওঠা পুরুষদের ‘জরিমানা’ করার সময়ে রেল পুলিশের সক্রিয়তার অভাব দেখা যায় না। কিন্তু নিরাপত্তা দেওয়ার বেলায় তাদের দেখা মেলা ভার। এমন কেন হবে? উত্তর এড়িয়ে গিয়েছেন কর্তারা। তবে যাত্রীদের অভিযোগে যে কিছুটা সত্যতা রয়েছে, তা ঠারেঠোরে স্বীকার করে নিয়েছেন রেল পুলিশের শীর্ষ কর্তারা।
রেল পুলিশের একটি অংশ অবশ্য এই ঘটনাকে ‘বিচ্ছিন্ন’ হিসেবেই দেখাতে চাইছেন। জিআরপি-র এক অফিসার বলছেন, এটা কোনও মাদকাসক্তের কাজ হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু নিত্যযাত্রীদের অনেকেই বলছেন, দুষ্কৃতীরা মাদকাসক্ত হলে কি নিরাপত্তা বাড়ে? বস্তুত, লোকাল ট্রেনের নিত্যযাত্রীদের বড় একটি অংশ মহিলা। এই ঘটনার পরে অনেকেই রাতের ফাঁকা ট্রেনে উঠতে ভয় পাবেন। শুচিস্মিতার মা বলছেন, “ভবিষ্যতে মেয়েকে আর ট্রেনে একা চাপতে দেব না।” প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে কি নিরাপত্তাহীনতা নিয়েই ট্রেনে চাপতে হবে মহিলা যাত্রীদের?
রেল পুলিশের এডিজি মৃত্যুঞ্জয়কুমার সিংহ বলছেন, “সোমবার থেকে প্রতিটি লোকাল ট্রেনের মহিলা-কামরায় ভোরে এবং রাতে দু’জন করে পুলিশকর্মী থাকবেন। যাঁদের এক জন হবেন মহিলা।”
ফের নিরাপত্তার আশ্বাস রেল পুলিশের। কিন্তু কত দিনের জন্য, সেটাই প্রশ্ন!