রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ে ধর্নায় এসএসসি পরীক্ষার্থীরা। বৃহস্পতিবার দুপুরে। ছবি: দেবস্মিতা চক্রবর্তী।
আদালতের রায়ই হোক বা লোকসভা নির্বাচনের ধাক্কা রাজ্যে সব স্তরে শিক্ষক বাছাইয়ের পরীক্ষা ও নিয়োগের সুপারিশ স্থগিত। ওই সব পরীক্ষা কবে হবে, আবেদনকারীদের সকলে পরীক্ষা দিতে পারবেন কি না, শূন্য পদগুলি কবে পূরণ হবে, এই সব প্রশ্ন উঠছেই। কিন্তু উত্তর জানা নেই কারও।
এই জটিলতায় সমস্যার সাঁড়াশি চেপে ধরেছে শিক্ষাকে। i লক্ষ লক্ষ আবেদনকারীর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। i শিক্ষকের অভাবে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসাগুলির পড়াশোনাও ব্যাহত হচ্ছে ভীষণ ভাবে। কারণ, সব মিলিয়ে আপাতত ৫০ হাজার শিক্ষক-পদ শূন্য রয়েছে রাজ্যে। বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত শিক্ষা দফতরের কর্তারাও। তবে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর আশ্বাস, নির্বাচনী বিধি বলবৎ হওয়ায় এখন নিয়োগ প্রক্রিয়া চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই ভোট পর্ব মেটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে। তার পরেই শুরু হবে কাজ।
এই মাসেই স্কুল সার্ভিস কমিশন (এসএসসি) আর প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের টিচার এলিজিবিলিটি টেস্ট (টেট) এবং মাদ্রাসার শিক্ষক বাছাইয়ের জন্য মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশনের শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল। এসএসসি-র টেট আর মাদ্রাসার পরীক্ষা ২৯ মার্চ এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য শিক্ষক বাছাইয়ের টেট ৩০ মার্চ নেওয়া হবে বলে ঘোষণা করা হয়েছিল।
কলকাতা হাইকোর্ট গত ১২ মার্চ রায় দিয়ে জানায়, সংখ্যালঘু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী নিয়োগ অবৈধ ও অসাংবিধানিক। তাই মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগ বন্ধের নির্দেশ দেন বিচারপতি সম্বুদ্ধ চক্রবর্তী। এই পরীক্ষায় প্রায় সাড়ে তিন হাজার পদের জন্য ৮৮ হাজার প্রার্থী আবেদন জানিয়েছিলেন। আবেদনকারীদের কী হবে, তা জানতে চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করা হবে বলে আগেই জানিয়েছিল কমিশন। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সেই আবেদন করা হয়নি।
মাদ্রাসায় নিয়োগ পরীক্ষা বন্ধের পরীক্ষার পরে আদালতের নির্দেশে স্থগিত হয়ে যায় এসএসসি-র টেট। সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলে নিয়োগের জন্য এ বছর থেকে দু’ভাগে পরীক্ষা নেওয়ার কথা কমিশনের। পঞ্চম-অষ্টম শ্রেণির জন্য টেট এবং নবম-দ্বাদশের জন্য বিষয়ভিত্তিক পরীক্ষা বা আরএলএসটি। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষকতার জন্য বিএড প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর টিচার এডুকেশন (এনসিটিই) জানিয়েছিল, এ বছর ৩১ মার্চের পরে প্রশিক্ষণহীন প্রার্থীরা শিক্ষক-পদে নিয়োগের পরীক্ষায় বসতে পারবেন না, তাঁদের নিয়োগও করা যাবে না।
২৯ মার্চ টেট হলেও ৩১ মার্চের মধ্যে শিক্ষক নিয়োগ সম্পন্ন করা যাবে না এবং সে-ক্ষেত্রে এনসিটিই-র নিয়ম লঙ্ঘিত হবে এই মর্মে হাইকোর্টে মামলা করেন এসএসসি-র আগেকার পরীক্ষায় সফল এক দল প্রার্থী। সেই মামলার শুনানির পরেই হাইকোর্ট নিয়োগ পরীক্ষার উপরে স্থগিতাদেশ জারি করে ২০ মার্চ। পাঁচ হাজার পদের জন্য ২৯ মার্চের টেটে প্রায় সাড়ে পাঁচ লক্ষ প্রার্থীর বসার কথা ছিল। এই পরীক্ষাটিও লোকসভা ভোট না-মেটা পর্যন্ত নেওয়া যাবে না। আর প্রশিক্ষণহীন প্রার্থীরা তাতে আদৌ বসতে পারবেন কি না, তাঁদের নিয়োগ করা যাবে কি না তা নিয়ে ঘোর অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে।
আবার টেটের পরে বিষয়ভিত্তিক পরীক্ষা বা আরএলএসটি-র দিন ঘোষণা করার কথা কমিশনের। তাই সেটি কবে হবে, তা-ও জানা নেই কারও। হাজার দশেক শূন্য পদে নিয়োগের জন্য এই পরীক্ষা নেওয়ার কথা। সব মিলিয়ে এসএসসি-র টেট স্থগিত হয়ে যাওয়ায় প্রায় ১৫ হাজার পদে শিক্ষক নিয়োগ আটকে গেল। গত তিন বছরে এক বারই পরীক্ষা নিয়েছে এসএসসি। ২০১২-র সেই পরীক্ষা, তার ফলপ্রকাশ এবং কাউন্সেলিং করে শিক্ষক নিয়োগের সুপারিশ নিয়ে অভিযোগ মামলার শেষ নেই। পরিণামে নিয়োগে ব্যাঘাত এবং ছাত্রছাত্রীদেরই সর্বনাশ।
আদালতের রায়ে থমকে যেতে হয়নি ঠিকই। কিন্তু লোকসভা নির্বাচনের জেরে প্রাথমিকের টেট পিছিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ। প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষক বাছাইয়ের এই পরীক্ষায় বসার জন্য আবেদনকারীর সংখ্যা ১৮ লক্ষ, শূন্য পদ ৩০ হাজার। এই পরীক্ষাও হবে ভোটের পরে। অর্থাৎ শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা স্থগিত হওয়ায় বা পিছিয়ে যাওয়ায় একেবারে প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত স্কুল স্তরের ১২টি শ্রেণির পঠনপাঠনই মোক্ষম ধাক্কা খাচ্ছে।
কলেজ সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা নিয়ে এমনিতে কোনও জটিলতা নেই। কিন্তু লোকসভা ভোটের জেরে সেই পরীক্ষার ফলপ্রকাশ আপাতত বন্ধ। কমিশন-কর্তৃপক্ষ এর মধ্যেই ফল প্রকাশ করার অনুমতি চেয়ে নির্বাচন কমিশনের কাছে আবেদন জানিয়েছেন। ফলপ্রকাশ আটকে থাকায় ঝুলে রয়েছে হাজার দশেক আবেদনকারীর ভাগ্য। আর নানা কলেজে ২,১০০ পদ খালি থাকায় ক্ষতি হচ্ছে পড়ুয়াদের।