পাচারের গরুর দাম সোনায়

সোনা পাচার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কপাল খুলেছে এ রাজ্যের সীমান্ত এলাকার গরু পাচারকারীদের। বাংলাদেশ থেকে কাঁচা টাকার বদলে গরুর দাম হিসাবে সোনার বিস্কুটে রফা হচ্ছে। যা এ দেশের বাজারে বিক্রি করে বাড়তি লাভের রাস্তা খুলে গিয়েছে। বাংলাদেশে সোনার দাম ভারতের থেকে প্রতি এক কিলোগ্রামে চার লক্ষ টাকা কম। তা ছাড়া, আমদানি শুল্ক ফাঁকি দিয়ে চোরা পথে এক কিলোগ্রাম সোনা এ দেশে আনলে বাড়তি লাভ আরও প্রায় তিন লক্ষ টাকার।

Advertisement

অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য ও নির্মল বসু

কলকাতা ও বসিরহাট শেষ আপডেট: ১৫ মার্চ ২০১৪ ০৩:৫৫
Share:

সোনা পাচার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কপাল খুলেছে এ রাজ্যের সীমান্ত এলাকার গরু পাচারকারীদের। বাংলাদেশ থেকে কাঁচা টাকার বদলে গরুর দাম হিসাবে সোনার বিস্কুটে রফা হচ্ছে। যা এ দেশের বাজারে বিক্রি করে বাড়তি লাভের রাস্তা খুলে গিয়েছে।

Advertisement

বাংলাদেশে সোনার দাম ভারতের থেকে প্রতি এক কিলোগ্রামে চার লক্ষ টাকা কম। তা ছাড়া, আমদানি শুল্ক ফাঁকি দিয়ে চোরা পথে এক কিলোগ্রাম সোনা এ দেশে আনলে বাড়তি লাভ আরও প্রায় তিন লক্ষ টাকার। সীমান্ত রক্ষী বাহিনী (বিএসএফ), ডিরেক্টরেট অফ রেভিনিউ ইন্টেলিজেন্স (ডিআরআই)-এর আধিকারিকদের দাবি, এ দেশ থেকে বাংলাদেশে গরু পাচার করে আগে নগদ বা হুন্ডিতে টাকা নেওয়াই দস্তুর ছিল। ইদানীং সেই পরিস্থিতি বদলাচ্ছে। গরুর দাম সোনার বিস্কুটে মেটাচ্ছে ও পারের ব্যবসায়ীরা। একে তো বিএসএফের চোখে ধুলো দিয়ে লক্ষ লক্ষ নগদ টাকা নিয়ে যাতায়াতে যথেষ্ট সমস্যা হয়। ধরপাকড় অনেক বেশি। নগদ টাকার বদলে ছোট ছোট সোনার বিস্কুট, বার বহন করা তুলনায় অনেক সহজ। আমদানি শুল্ক ফাঁকি দিয়ে কলকাতা বা মুম্বইয়ে বিক্রি হয়ে যায় ওই সোনা।

গত ছ’মাসে সীমান্ত রক্ষীদের হাতে প্রায় ১৫ বার ধরা পড়ছে সোনা পাচারকারীরা। শুধু উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাট, স্বরূপনগর সীমান্তে প্রায় ২০ কোটি টাকার সোনা এবং বনগাঁর পেট্রাপোল সীমান্তে ১৫ কোটি টাকার মতো সোনা বাজেয়াপ্ত করেছে শুল্ক দফতর এবং বিএসএফ। কলকাতা বিমানবন্দরেও ধরা পড়েছে সোনা। দিন কয়েক আগে বসিরহাটে এবং বৃহস্পতিবার কলকাতার বড়বাজারে বহু টাকার সোনা বাজেয়াপ্ত করেছে ডিআরআই। শুক্রবারেও স্বরূপনগরের হাকিমপুরে সোনাই নদীর পাড় থেকে ৫০০ গ্রাম সোনা-সহ অসীম ভট্টাচার্য নামে এক ব্যক্তিকে ধরে বিএসএফ।

Advertisement

রাজস্ব গোয়েন্দাদের দাবি, গত শনিবার বসিরহাট থেকে সোনা পাচারে জড়িত অভিযোগে আব্দুল বারিক বিশ্বাসকে গ্রেফতার করার করার পরে, জেরায় এ ব্যাপারে নানা তথ্য মিলেছে। জেরায় তাঁরা জেনেছেন, সীমান্তে যারা গরু পাচারে যুক্ত ছিল, তারাই এখন সোনা পাচারে নেমেছে। উত্তর ২৪ পরগনার পাচারকারীরা কলকাতার বড়বাজার এবং মুম্বইয়ের বড় সোনার ব্যবসায়ীদের কাছে চোরাই সোনা বিক্রি করছে। এর সঙ্গে একটি বড় মাফিয়া চক্রও যুক্ত রয়ছে। কিন্তু পুলিশ ও বিএসএফ কর্তাদের একাংশের মতে, যে পরিমাণ সোনা ধরা পড়েছে, আর যে পরিমাণ সোনা পাচার হচ্ছে, তার মধ্যে তফাৎ বিস্তর।

এসডিপিও (বসিরহাট) অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “ধরা পড়া পাচারকারীদের জেরা করে জানা গিয়েছে, একটা গরু প্রতিবেশী রাষ্ট্রে যে টাকায় বিক্রি হয়, সেই টাকার সোনা এ দেশে চোরা পথে এনে বিক্রি করতে পারলে দু’দফায় লাভ। একে এ দেশে সোনার দাম বেশি। দ্বিতীয়ত, আমদানি শুল্কও ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে।”

তবে এ রাজ্যের স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের একাংশ মনে করেন সরকারি বিধি বদল এবং শুল্ক বৃদ্ধির জেরেই পোয়া বারো হয়েছে সোনা পাচারকারীদের।

আগে নিয়ম ছিল, বিদেশ থেকে শুধু ব্যাঙ্কের মাধ্যমে সোনা আমদানি করবে সরকার। ব্যাঙ্কের থেকে সোনা কিনে অলঙ্কার গড়ে বাজারে তা বিক্রি করবেন স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা। সোনার আমদানি শুল্কও ছিল মাত্র ১ শতাংশ। প্রায় এক বছর হল ব্যাঙ্কের মাধ্যমে সোনা আমদানি বন্ধ করেছে সরকার। আমদানি শুল্ক হয়েছে ১০ শতাংশ। অভিযোগ, এ জন্যই স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের একটা বড় অংশ (মূলত সেই সব ক্ষুদ্র স্বর্ণশিল্পী যাঁদের নিজস্ব ব্যবসা রয়েছে) সোনা কিনতে পারছেন না। আর বাজারে সোনার সেই চাহিদাকেই মূলধন করেছে সোনা পাচারকারীরা।

‘বঙ্গীয় স্বর্ণশিল্পী সমিতি’র জেলা সভাপতি বিনয় সিংহ বলেন, “ব্যাঙ্কের মাধ্যমে সোনা আমদানি বন্ধ করেছে সরকার। আমদানি শুল্ক ১০ গুণ বেড়েছে। আমরা সোনা কিনব কোথা থেকে? সেই সুযোগই কাজে লাগাচ্ছে চোরাচালানকারীরা।” সংগঠনটির অভিযোগ, সরকারই সোনা পাচারের সুযোগ করে দিয়েছে।

তবে ডিআরআই-এর গোয়েন্দারা কিন্তু এ অভিযোগ পুরোপুরি মানছেন না। তাঁদের বক্তব্য, বর্তমান সরকারি বিধি হলএক কিলোগ্রাম সোনার অলঙ্কার বিদেশে রফতানি করলে, পরিবর্তে পাঁচ কিলোগ্রাম কাঁচা সোনা ১০ শতাংশ শুল্ক দিয়ে আমদানি করা যাবে। তার মধ্যে চার কিলো বাজারে বিক্রি করা যাবে। কিন্তু পুঁজির কারণে ক্ষুদ্র স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের একটা অংশ স্বর্ণালঙ্কার বিদেশে রফতানি করতে পারেন না। আবার তাঁরা আমদানি শুল্ক দিয়ে সোনা কেনার ক্ষমতাও রাখেন না। ফলে, তাঁদের একাংশ পাচারকারীদের থেকে কম দামে সোনা কিনে তা দিয়ে ব্যবসা করছেন। যদিও বসিরহাট মহকুমার স্বর্ণশিল্পী সমিতির সভাপতি অশোক ভদ্র বলেন, “যাঁরা অসাধু, তাঁরা অসাধুই। প্রকৃত পক্ষে চোরাই সোনার রমরমা কারবার ছড়িয়ে পড়ায় ছোট ব্যবসায়ীরাই মার খাচ্ছেন।”

রাজস্ব গোয়েন্দাদের দাবি, ২২ ক্যারাট (গয়নার সোনা) সোনা বিক্রি করতে হলে শুল্ক চালানের (ট্যাক্স ইনভয়েস) নম্বর দেওয়া রসিদ ক্রেতাকে দিতে হবে। সোনা বৈধ কি না, সেই নম্বরটি যাচাই করা হলেই ধরা পড়বে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই রসিদে নকল চালান নম্বর লিখে দেওয়া হচ্ছে ক্রেতাদের। ক্রেতারাও না জেনে চোরাই সোনা কিনছেন।

‘স্বর্ণশিল্পী সমিতি’র বক্তব্য, “আমদানির নীতি বদলানো না হলে, সোনাপাচার চলতেই থাকবে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন