মুখ ঢাকো লজ্জায়

পাছে দাপট কমে যায়, শাসকের ভরসা তাণ্ডবে

কয়েক মাস আগে কলকাতা-সহ ৯১টি পুরসভার ভোটের পরেই প্রশ্নটা উঠেছিল। এ বার আড়াইখানা পুর-নিগমের ভোটে আরও জোরালো হয়ে এল সেই একই জিজ্ঞাসা! এত গা-জোয়ারির ভোটের কি কোনও দরকার ছিল?

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০১৫ ০৩:১৯
Share:

ওরম তাকিও না! কোথায় থাকেন, সল্টলেকেই? প্রশ্ন শুনে প্রথমে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা। তার পরে ক্যামেরার চোখ থেকে বাঁচতে ঢেকে ফেললেন মুখ। এবি-এসি ব্লকে একটি বুথে। শনিবার। ছবি: সুমন বল্লভ।

কয়েক মাস আগে কলকাতা-সহ ৯১টি পুরসভার ভোটের পরেই প্রশ্নটা উঠেছিল। এ বার আড়াইখানা পুর-নিগমের ভোটে আরও জোরালো হয়ে এল সেই একই জিজ্ঞাসা! এত গা-জোয়ারির ভোটের কি কোনও দরকার ছিল?

Advertisement

বিধাননগর ও রাজারহাটের একের পর এক ওয়ার্ড, আসানসোলের বিস্তীর্ণ এলাকা এবং বালিতে শনিবার দিনভর পুরভোটের নামে দাপট চলল বহিরাগত দুষ্কৃতীদের। বিরোধী এজেন্টদের রাস্তায় ফেলে মারধর, বুথ থেকে বার করে দেওয়া, প্রার্থীদের উপরে হামলা, ভোটার লাইনে বোমা-গুলির আক্রমণ— এ সব তো ছিলই। বিধাননগর পুর-নিগমের মধ্যে সল্টলেক অংশের ভোটের জন্য তৃণমূলের দুই বিধায়ক সুজিত বসু এবং পরেশ পালকে (যাঁদের কেউই বিধাননগরের ভোটার নন) দলবল নিয়ে দাপিয়ে বেড়াতে দেখা গেল।

খবর করতে গিয়ে আক্রান্ত হতে হল আনন্দবাজার পত্রিকা, দ্য টেলিগ্রাফ এবং এবিপি আনন্দ-সহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের অন্তত ১৯ জন সাংবাদিক ও চিত্র সাংবাদিককে। দিনভর এমন তাণ্ডবের পরে শাসক দলের অন্দরেই প্রশ্ন, সামান্য কিছু পুরসভা, যেখানে বিরোধীদের চেয়ে ধারে-ভারে ভাল ভাবেই এগিয়ে তৃণমূল, সেখানকার ভোট ঘিরে এত কিছুর কি খুব প্রয়োজন ছিল? এতে ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনের আগে জনমানসে দলের ভাবমূর্তিতে কি আরও কালো দাগ বসে গেল না?

Advertisement

তৃণমূল শিবির সূত্রেই এমন গা-জোয়ারি ও বেপরোয়া সন্ত্রাসের নেপথ্যে কয়েকটি কারণ উঠে আসছে। প্রথমত, একের পর এক নির্বাচনে ধারাবাহিক সাফল্যের পরেও মনে মনে কোথাও একটা ভয় থেকে যাচ্ছে! অবাধ ভোট হতে দিলে কয়েকটা ওয়ার্ডও যদি এ দিক-ও দিক হয়, পাছে তাতে মনে হয় এলাকার উপরে শাসক দলের মুষ্টি আলগা হয়ে আসছে! বিধানসভা ভোটের আগে তাতে যদি অক্সিজেন পেয়ে যায় বিরোধীরা! দ্বিতীয়ত, প্রতিটা এলাকাই এখন তৃণমূলের নানা গোষ্ঠীর দ্বন্দ্বে দীর্ণ। এক গোষ্ঠীর ভয়, অন্য গোষ্ঠী বুঝি তাদের টপকে গেল! তাই ঝুঁকি না নিয়ে কে কত ‘লুঠ’ করতে পারে, তার বেপরোয়া প্রতিযোগিতা চলছে। আর তৃতীয়ত, নিচু তলার বাহিনীর উপরে আর কোনও নিয়ন্ত্রণই নেই তৃণমূল নেতৃত্বের। এক কালে নির্বাচনের মতো ব্যাপারে তৃণমূলে চূড়ান্ত ক্ষমতা ছিল দলের তৎকালীন সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের হাতে। এখন গোটা দলের উপরে নিয়ন্ত্রণ রাখার মতো দক্ষতা তৃণমূলের কোনও নেতারই নেই।

তৃণমূলের অন্দর মহল সম্পর্কে অবহিত এক নেতার মন্তব্য, ‘‘জেতার জন্য কী করতে হবে, দলের এখন জানা নেই। জেতার জন্য কতটুকু করতে হবে, সেটাও জানা নেই!’’ দলেরই অন্য এক নেতার আক্ষেপ, ‘‘এটা তো খুব বড় কিছু ভোট নয়। এখানে সুষ্ঠু ভোট হতে দিলে বুঝে নেওয়া যেত, স্বাভাবিক ভাবে কতটা জনসমর্থন আমাদের পক্ষে।’’

এ সবই অবশ্য অন্দরের আলোচনা। প্রকাশ্যে তৃণমূল নেতৃত্ব এ দিনের ঘটনার জন্য দোষ চাপিয়েছেন বিরোধীদের ঘাড়েই! স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রে বলা হয়েছে, শাসক দল অশান্তি করলে তা প্রশাসনের বিরুদ্ধেই যায়। তাই তারা অশান্তি করতেই পারে না। যা ঘটেছে, তার বেশির ভাগই সিপিএম, কোথাও বিজেপি, কোথাও কংগ্রেস করেছে।

গোটা দিন শাসক দলের তাণ্ডবের পাশাপাশিই চোখে পড়েছে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা। প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ বলছে, কোথাও কোথাও ভোটারদের বাধা দেওয়ার কাজে বহিরাগতদের মদতই দিয়েছে পুলিশ! তবে তার মধ্যেই দু-একটা জায়গায় স্থানীয় মানুষের চাপে পুলিশ বহিরাগতদের সরিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু পুলিশের সেই ভূমিকাকে ভাল চোখে দেখেননি মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রী! ঘনিষ্ঠ মহলে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন, কিছু এলাকায় সিপিএম বা বিজেপি গোলমাল পাকালেও পুলিশ তৃণমূলকেই

‘অযথা মারধর’ করেছে! পুলিশের এই ভূমিকা খতিয়ে দেখে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

দলনেত্রীর মন বুঝেই তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় এ দিন অভিযোগ করেছেন, ‘সিপিএম, কংগ্রেস, বিজেপি-র লোকবল নেই। মানুষ তাদের সঙ্গে নেই। তাই যুদ্ধের আগেই হারার ভয়ে এ রাজ্যে তারা যে রাজনৈতিক আচরণ করছে, তা গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার সামিল!’’ সিপিএমের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আগামী মঙ্গলবার দুপুরে কলেজ স্ট্রিট থেকে রানি রাসমণি অ্যাভিনিউ পর্যন্ত মিছিলের ডাকও দিয়েছে তৃণমূল। কলকাতায় দলের সব বিধায়ক, কাউন্সিলর এবং কলকাতা জেলার সব শাখা সংগঠনকে সে দিন পথে নামানো হবে বলে জানিয়েছেন পার্থবাবু। এমনকী, বহিরাগতদের দাপিয়ে বেড়ানোর দায়ও নির্বাচন কমিশনের উপরে চাপিয়ে দিয়েছেন তিনি। বলেছেন, ‘‘বহিরাগতরা তো থাকবেই! তাদের আটকানোর দায়িত্ব আমাদের, না নির্বাচন কমিশনের? আমরা হাত দিলে তো বলা হবে, স্বাধিকারে হাত দিয়েছে!’’ আর এক মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমও বিধাননগরে গোলমালের প্রসঙ্গে দাবি করেছেন, ‘‘রমলা চক্রবর্তী আর সিপিএম বহিরাগত এনে সন্ত্রাস তৈরির চেষ্টা করেছে। অরাজকতা তৈরি করেছে!’’

বিরোধীরা স্বভাবতই ভোটের নামে এই প্রহসনের বিরুদ্ধে সরব। কিন্তু এ দিন শাসক দলের একচ্ছত্র তাণ্ডবে প্রশ্ন উঠে গিয়েছে বিরোধীদের প্রতিরোধ নিয়েও। বিরোধীদের ‘শিলিগুড়ি মডেল’ শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদের ভোটে ফের কাজ করলেও দক্ষিণবঙ্গে তেমন ভাবে কার্যকর হয়নি। বিধাননগরে যেমন ‘সিটিজেন্স ফোরাম’ ভোটের দিন দাগ কাটতেই পারেনি! শাসক দলের তাণ্ডবের মোকাবিলায় প্রতিরোধের কোনও ‘অভিন্ন মডেল’ এখনও কাজ করছে না বলে মেনে নিচ্ছেন বাম নেতৃত্বও। প্রতিরোধের কিছু ছবি জামুড়িয়া বা খড়গপুরে দেখা গিয়েছে ঠিকই। কিন্তু সর্বত্র যে প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়নি, এ দিন মেনেও নিয়েছেন বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু। তাঁর বক্তব্য, ‘‘আমরা বলেছিলাম, ভোট দিতে না-পারলে যেখানে যেখানে সম্ভব অবস্থানে বসতে হবে, প্রয়োজনে প্রতিরোধও করতে হবে। সব রিপোর্ট এখনও পাইনি। তবে আমার মনে হয়, যেখানে সম্ভব, প্রতিরোধ হয়েছে। যেখানে সম্ভব হয়নি, প্রতিরোধ করা যায়নি।’’

তার জন্য শাসক দলকে অবশ্য ছেড়ে কথা বলছে না বিরোধীরা। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র বিবৃতিতে বলেছেন, ‘এটা স্পষ্ট যে, রাজ্য সরকার, পুলিশ প্রশাসন ও শাসক দল জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। ক্রমবর্ধমান জনবিচ্ছিন্নতায় আতঙ্কিত হয়েই নির্বাচনের ফলাফল নিজেদের অনুকূলে আনতে তারা বলপ্রয়োগ করে মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নিতে চেয়েছে’। ভোটের নামে প্রহসনের প্রতিবাদেই সোমবার রাজ্য জুড়ে ‘ধিক্কার দিবসে’র ডাক দিয়েছে বামেরা। সে দিন ‘লালবাজার অভিযানে’র উপরে পুলিশের লাঠিচালনা এবং ভোট লুঠের প্রতিবাদে কলকাতায় বামেদের মিছিল হবে। বিধাননগর-রাজারহাট এলাকায় সোমবারই ১২ ঘণ্টার বন্‌ধের ডাক দিয়েছেন সিপিএমের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক গৌতম দেব। সেই বন্‌ধকে সমর্থন করেছে এসইউসি। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীও বলেছেন, ‘‘আজকের কয়েকটা পুরসভা, পঞ্চায়েত ভোটেই স্পষ্ট, কতটা ভয় পেয়েছে তৃণমূল!’’

কংগ্রেস এবং বিজেপি এ দিনের সব ভোট বাতিল করে নতুন করে নির্বাচনের দাবিতে রাজ্য নির্বাচন কমিশনার সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায়ের কাছে ধর্না দিয়েছে। বামেরা দাবি করেছে, শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদ বাদে বিধাননগর, আসানসোল ও বালিতে পুনর্নির্বাচন করাতে হবে। এই দাবি নিয়ে দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত কমিশনে ধর্না-অবস্থান চালিয়েছে বিজেপি ও বামেরা।

রাত পর্যন্ত কমিশন অবশ্য কোথাও পুনর্নির্বাচনের নির্দেশ দেয়নি। কমিশন সূত্রে জানানো হয়েছে, বিধাননগরে ৭৬%, আসানসোলে ৬২%, বালিতে ৭২% এবং শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদে ৭৩.৫% ভোট পড়েছে।

পড়ুন: বেঁচে ফেরার অভিজ্ঞতা

পড়ুন: দিনভর চলল ‘ভোট-লুঠ’, সব দেখেও সুশান্ত শান্তই

পড়ুন: ভোট দেওয়াই হল না, গেরো রহস্যের মেরো

পড়ুন: সাংবাদিক নিগ্রহের নিন্দা, গ্রেফতারির দাবি

পড়ুন: ভোট করাল ভজাইরা, পাহারা দিল পুলিশই

পড়ুন: এ রকম ‘পিসফুল’ ভোটই ভাল, তাই না!

পড়ুন: ইহারা জননীর গর্ভের লজ্জা

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন