প্রমোদতরণী ভাসছে, পর্যটন কই

গঙ্গাবক্ষে একের পর এক চালু হচ্ছে প্রমোদতরণী। সরকার প্রয়োজন মতো সাহায্যও করছে সংস্থাগুলিকে। বাড়ছে যাত্রীসংখ্যা। পর্যটন বিভাগের দাবি, এর ফলে উন্নতি হচ্ছে পশ্চিবঙ্গের পর্যটনেরও। কিন্তু আদৌ কি লাভবান হচ্ছে রাজ্যের পর্যটন? প্রশ্ন তা নিয়েই।

Advertisement

তানিয়া বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০১৫ ০০:৫১
Share:

গঙ্গাবক্ষে একের পর এক চালু হচ্ছে প্রমোদতরণী। সরকার প্রয়োজন মতো সাহায্যও করছে সংস্থাগুলিকে। বাড়ছে যাত্রীসংখ্যা। পর্যটন বিভাগের দাবি, এর ফলে উন্নতি হচ্ছে পশ্চিবঙ্গের পর্যটনেরও। কিন্তু আদৌ কি লাভবান হচ্ছে রাজ্যের পর্যটন? প্রশ্ন তা নিয়েই।

Advertisement

গঙ্গাবক্ষে আগেই চালু হয়েছে তিনটি বিলাসবহুল প্রমোদতরণী ও একটি ইয়ট। এ বার সেগুলিকেও প্রাচুর্য ও বিলাসিতায় টেক্কা দিতে আর একটি ইয়ট চালু হল হুগলি নদীতে। তবে এই ইয়ট বা প্রমোদতরণীর বেশিরভাগ পর্যটকই বিদেশি। কলকাতা নয়, তাঁদের মূল আকর্ষণ উত্তরভারত। এ শহর থেকে যাত্রা শুরু হওয়ায় রাজ্য সরকার শুধু কিছু কর আদায় করতে পারে মাত্র।

যদিও রাজ্যের পর্যটন মন্ত্রী ব্রাত্য বসুর দাবি, বিগত চার বছরে পশ্চিমবঙ্গের পর্যটন শিল্পের যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটেছে। তিনি বলেন, ‘‘ভিভাডায় রোজ বুকিং থাকছে, বিদেশ থেকে পর্যটক আসছেন।’’ ভিভাডার মতো প্রমোদতরণীগুলি আগামী প্রায় দু’বছরের জন্য বুক করা আছে। কিন্তু এগুলি মূলত কলকাতা থেকে বারাণসী যাতায়াত করে। যাতে কমপক্ষে সময় লাগে পনেরো দিন। কলকাতায় বর্তমানে ব্যয়বহুল প্রমোদতরণী মাত্র তিনটি। সুতরাং, খুব বেশি সংখ্যক যে পর্যটক আসছেন, তা নয়। দু’টি প্রমোদতরণী রয়েছে রাজ্য পর্যটন দফতরেরও। যা মূলত সুন্দরবন যাতায়াত করে। সেগুলি অবশ্য অত বিলাসবহুল নয়।

Advertisement

ভিভাডার অধিকর্তা সুশীলা রামমূর্তি জানান, ‘‘প্রমোদতরণীগুলিতে পর্যটকেরা আসেন সংস্থার নিজেদের উদ্যোগে। বিভিন্ন বাণিজ্য মেলায় আমাদের সংস্থা নিজেদের উদ্যোগে যায় ও পর্যটকদের নিয়ে আসার ব্যবস্থা করে। তিনটি প্রমোদতরণীর মধ্যে যেটি কলকাতা থেকে বারাণসী যায়, তাতেই বেশি ভিড় থাকে। কিন্তু ফরাক্কা বা সুন্দরবনে যায় যেগুলি, সেগুলি মোটামুটি চলে। বিদেশি পর্যটকদের গন্তব্য কলকাতা থেকে বারাণসী। তাঁরা মূলত দেখতে যান উত্তর ভারত। পশ্চিমবঙ্গ বা কলকাতা নয়।’’ তাঁর অভিযোগ, ‘‘২০০৭-এ যখন এখানে ব্যবসা শুরু হয় তখন পশ্চিমবঙ্গ সরকার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় অংশগ্রহণ করলেও, বিগত দু’বছরে তা কমেছে। পশ্চিমবঙ্গকে পর্যটনে এগিয়ে নিয়ে যেতে সরকারের নিজেকে তুলে ধরা দরকার।’’

অনেকেরই দাবি, প্রমোদতরণীতে ভিড় হওয়ার যুক্তি দেখিয়ে পর্যটন মন্ত্রী রাজ্যের পর্যটনের যে ‘অগ্রগতি’র কথা বলছেন তা আসলে সত্য নয়। এ ক্ষেত্রে রাজ্য পর্যটন দফতরের কোনও ভূমিকা নেই। রাজ্য প্রশাসনের এক অধিকর্তা জানান, কলকাতা থেকে যাত্রা শুরু হওয়ায় সরকার কিছু কর আদায় করতে পারে মাত্র। শুধুমাত্র এটিই রাজ্যের লাভ।

শহরে প্রচুর বিদেশি পর্যটক দেখা গেলেও তাঁরা যে কলকাতা শহর দেখতে খুব একটা আগ্রহী নন, তার বেশ কিছু কারণ আছে বলে মনে করছে বিভিন্ন মহল। বিশেষজ্ঞদের মতে, যেখানে আইন-শৃঙ্খলার রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে রোজ প্রশ্ন ওঠে, সে শহর কখনওই পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় হবে না। তা ছাড়া, বেহাল রাস্তা, যানজট, বর্ষাকালে রাস্তায় জল জমা তো এ শহরের চেনা ছবি। গাড়ি রাখারও পর্যাপ্ত জায়গার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। ঠিক মতো রক্ষণাবেক্ষণ হয় না দর্শনীয় ঐতিহাসিক স্থানগুলিরও। কালীঘাট থেকে প্রিন্সেপ ঘাট, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল থেকে দক্ষিণেশ্বর, সর্বত্র ছবিটা একই— নোংরা ও অবাঞ্ছিত লোকজনের ভিড়। অবস্থা খারাপ হুগলি নদীর চারপাশের ঘাটগুলিরও। কোথাও জলে ভেসে আসা মৃতদেহ, কোথাও নোংরা-আবর্জনায় ভর্তি। এই ‘সৌন্দর্য’ দেখতে কতখানি ইচ্ছুক পর্যটকেরা আর সেই শহর পর্যটকদের কাছে কতটা আকর্ষণীয়, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায় বলে মত বিভিন্ন মহলের। এ ছাড়া, অনেকে মনে করছেন কলকাতায় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থাকা সত্ত্বেও এখান থেকে ইউরোপ বা আমেরিকায় যাতায়াতের কোনও সরাসরি বিমান পরিষেবা না থাকায় স্বাভাবিক ভাবেই বিদেশি পর্যটকদের এ রাজ্যে আসার তেমন আকর্ষণ নেই।

এ শহরে এসে তাঁরা যে নানা রকম সমস্যার সম্মুখীন হন, বিদেশি পর্যটকদের অভিজ্ঞতাও বলছে তেমনটাই। এখানে গাইডের ব্যবস্থা না থাকায় সেই সুযোগ নেয় জালিয়াতেরা। আর অনেক সময়েই তাদের কবলে পড়েন বিদেশি পর্যটকরা।

যে বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে ব্যয়বহুল প্রমোদতরণী চালু হচ্ছে, তাদেরও মুখে শোনা যাচ্ছে কলকাতায় পরিকাঠামো না থাকার কথা। তাদের কথায়, এ শহরকে দেখতে আসার ইচ্ছে তেমন ভাবে নেই বিদেশি পর্যটকদের। কারণ এখানকার মৌলিক পরিকাঠামোর অভাব। মিলেনিয়াম পার্কের চারপাশের রাস্তার ট্রাফিকের অবস্থা খারাপ। গাড়ি রাখারও জায়গা নেই। তা ছাড়া, এই প্রমোদতরণীগুলির রক্ষণাবেক্ষণে যে ধরনের পরিস্রুত জলের প্রয়োজন, যথেষ্ট অভাব রয়েছে তারও।

অপর্যাপ্ত পরিকাঠামোর কথা অবশ্য মেনে নিয়েছেন খোদ রাজ্য পরিবহণ সচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ও। তিনি বলেন, পশ্চিমবঙ্গে এখনও সম্পূর্ণ পরিকাঠামো গড়ে ওঠেনি, বিশেষত প্রযুক্তিগত দিক থেকে খুব একটা উন্নতি হয়নি, প্রমোদতরণী রক্ষণাবেক্ষণেরও পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। তবে তিনি এই অব্যবস্থার জন্য প্রশাসন ও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে যথাযথ যোগাযোগের অভাবকেই দায়ী করেছেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন