অভাব বরাতের। দুর্যোগের ঘনঘটা চটশিল্পে।
গত কয়েক মাসে এ রাজ্যে চারটি চটকল বন্ধ হয়েছে। কাজ হারিয়েছেন লক্ষাধিক চটকল-শ্রমিক। পরিস্থিতি এমনই দাঁড়িয়েছে যে, আরও কয়েকটি চটকলে তালা পড়তে পারে বলে সরকারি সূত্রেই আশঙ্কা করা হচ্ছে। সদ্য কেনিসন মিল বন্ধ হয়ে যাওয়াটা তারই ইঙ্গিত বলে জানাচ্ছে সংশ্লিষ্ট মহল। কিন্তু সঙ্কট এত তীব্র হল কেন?
এক কথায় পঞ্জাবের হাতে টাকা নেই। পশ্চিমবঙ্গের চটকলগুলি তাই সঙ্কটে। এতটাই যে, কেন্দ্রীয় বস্ত্র মন্ত্রক থেকে শুরু করে চটকল-মালিক, আশু সমাধান জানা নেই কারও। কিন্তু পঞ্জাবের ভূমিকা এত বড় হচ্ছে কেন?
বস্ত্র মন্ত্রক সূত্রের খবর, বাংলার চটকল থেকে বস্তা কেনে মূলত পঞ্জাব, হরিয়ানা, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তীসগঢ়। ওই সব রাজ্যের মধ্যেও আবার পঞ্জাবই পশ্চিমবঙ্গের চটের সব থেকে বড় ক্রেতা। বছরে এ রাজ্য থেকে প্রায় ২৪ লক্ষ বেল চটের বস্তা কেনা হলে, তার মধ্যে অন্তত ১৪ লক্ষ বেল বস্তা কেনে পঞ্জাব সরকার। কিন্তু এ বার পঞ্জাব বস্তা কিনবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা কেন্দ্রীয় বস্ত্র মন্ত্রককে জানিয়ে দিয়েছে, আর্থিক সঙ্কটের জন্য পুরনো বস্তাতেই খাদ্যশস্য মজুত করা হবে। শুধু তা-ই নয়, খাদ্য সুরক্ষা আইন মেনে (গরিবদের খাদ্যশস্য সরবরাহের জন্য) রাজ্যগুলির ৩০ কিলোগ্রামের যে-সব বস্তা কেনার কথা, তা-ও কিনবে না পঞ্জাব। সে-ক্ষেত্রেও চটের বদলে প্লাস্টিকের বস্তা কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পঞ্জাব। সব মিলিয়ে ক্রেতা হিসেবে হাত গোটাচ্ছে তারা।
এবং পাল্লা দিয়ে মেঘ ঘনাচ্ছে বাংলার চটশিল্পে। সরকারি সূত্রের খবর, গঙ্গার দু’পারে রাজ্যের ৫৮টি চটকল এখনও পুরোপুরি সরকারি বরাতের উপরে নির্ভরশীল। খাদ্যশস্য এবং অন্যান্য সামগ্রী মজুতের জন্য বিভিন্ন রাজ্য সরকার প্রতি বছর চটের বস্তা কেনে। তার জোরেই এ রাজ্যের চটকলগুলি এখনও কোনও ক্রমে টিকে রয়েছে। কিন্তু শুধু পঞ্জাব নয়, গত নভেম্বর থেকে অন্যান্য রাজ্যও চটের বস্তা কেনা কমিয়ে দিয়েছে। ফলে সঙ্কট শুরু হয়েছিল তখন থেকেই। এ বছর তার মাত্রা বেশি।
কতটা বেশি, তার পরিসংখ্যাম দিয়েছেন চটকল-মালিকদের সংগঠনের সভাপতি রাঘবেন্দ্র গুপ্ত। তিনি জানান, এ রাজ্যের চটকলগুলিতে মাসে তিন লক্ষ ৭৫ হাজার বেল চটের বস্তা উৎপাদন হয়। জুলাইয়ে মাত্র এক লক্ষ ৪০ হাজার বেল বস্তা কেনার জন্য বরাত এসেছে। বিভিন্ন চটকলের গুদামে এখনও জমে রয়েছে দু’লক্ষ বেল চটের বস্তা। “অগস্টেও আহামরি কোনও বরাত পাওয়া যাবে না বলেই শুনেছি,” রাঘববাবুর গলায় হতাশা।
তা হলে উপায় কী হবে?
রাঘববাবু জানান, ইতিমধ্যেই সব মিল তাদের উৎপাদন ক্ষমতা ৫০ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছে। তার জেরে লক্ষাধিক শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন। চারটি মিল বন্ধ হয়ে গিয়েছে। “জানি না, আর ক’টি বন্ধ হবে। কেন্দ্রীয় বস্ত্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে আমরা এর বিহিত চেয়েছি। রাজ্যগুলি যাতে চটের বস্তা কেনা বন্ধ না-করে, সেই আর্জিও জানানো হয়েছে,” বললেন চটকল-মালিক সংগঠনের ওই কর্তা।
তবে বস্ত্র মন্ত্রকের খবর, চটকল-মালিকদের আর্জিতেও বিশেষ কাজ হয়নি। কেন্দ্রীয় বস্ত্রমন্ত্রী সন্তোষ গাঙ্গোয়ার পঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ সিংহ বাদলকে চিঠি লিখে বাংলার চটকলগুলি থেকে বস্তা কেনার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু আর্থিক সঙ্কটের কথা বলে পঞ্জাব বস্তা কিনতে অপারগ বলে জানিয়ে দিয়েছে।
এখানকার চটকলের সঙ্কট কাটাতে পঞ্জাবের মুখাপেক্ষী হয়ে না-থেকে রাজ্য সরকার চটের বস্তা কিনছে না কেন, সেই প্রশ্নও উঠেছে। চটকল-মালিকদের পক্ষে রাঘববাবুর দাবি, নর্থব্রুক কাণ্ডের পরে রাজ্যের চার মন্ত্রী মালিকদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন। ওই বৈঠকে আলু ও ধান মজুতের জন্য চটের বস্তা কেনার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। তার পর থেকে সরকার আর উচ্চবাচ্য করেনি। রাজ্য বস্তা কিনতে এগিয়ে এলে সমস্যা কিছুটা মিটবে। যদিও রাজ্যের অর্থ দফতরের এক কর্তা বলেন, “পঞ্জাবের থেকেও এ রাজ্যের আর্থিক অবস্থা খারাপ। ফলে চটের বস্তা কেনার কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি।”
তবে সামান্য একটু আলো দেখা যাচ্ছে জুট কমিশনার সুব্রত গুপ্তের আশ্বাসে। তিনি বলেন, “পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা চলছে। অগস্টে যাতে আড়াই লক্ষ বেল চটের বস্তা কেনা যায়, তার ব্যবস্থা হচ্ছে।”