ছবিতে দেখা এমন নিসর্গের টানেই আসছেন পর্যটকেরা। —নিজস্ব চিত্র।
পাহাড়ের ধাপে-ধাপে উঠে যাওয়া ফার-পাইনের চোখ জুড়োনো সবুজ আর পাহাড়ের মাথায় মেঘ-রোদ্দুরে লুকোচুরি।
‘তিতলি’ ছবির সেই দৃশ্য দেখেই নাকি ডুয়ার্সের চা বাগানে যাওয়া ঠিক করে ফেলেছিলেন অর্ক আর তৃষা। গৌতম ঘোষের ‘মনের মানুষ’ দেখে আবার কলকাতার সরকারি কর্মী জয় বাগচীর ইচ্ছে হয় চিলাপাতা অরণ্য ঘুরে দেখার। গৌতমেরই ‘দেখা’ চাপরামারি জঙ্গলে টেনেছিল কলকাতায় এক বহুজাতিক সংস্থায় কর্মরত রাজদীপ ঘোষকে। সেই টানেই ট্যুর অপারেটরদের দ্বারস্থ হয়েছিলেন তাঁরা।
হাওয়া বুঝে এখন ট্যুর অপারেটর তথা ভ্রমণ সংস্থাগুলিও ব্যবসার হাতিয়ার করতে চাইছেন সিনেমাকে। হিট ছবির শু্যটিং লোকেশনের ফোটোগ্রাফ দিয়ে কেউ সাজিয়ে তুলছেন রিসর্টের ডাইনিং স্পেস, বেডরুম, রিসেপশন। কেউ বা আবার শু্যটিং স্পটগুলি তুলে ধরছেন সংস্থার ওয়েবসাইট এবং ব্রোশিওরে। যাদবপুর ফিল্ম স্টাডিজের অধ্যাপক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের মতে, সেলুলয়েডে মোড়া প্রকৃতির যে সৌন্দর্য, তার গুণগত মান অনেক বেশি। গল্পের অংশ হিসেবে দেখানো হয় বলে দর্শকদের তা অনেক বেশি আকর্ষণ করে।
বাঙালির যে কোনও জিনিসের সঙ্গে বেড়ানো ব্যাপারটা জুড়ে দিতে পারলে তা সহজে চোখ টানে, লোকও টানে। তাই বেশ কিছু দিন ধরেই বাংলা ছবির সেট ফেলা হচ্ছে নয়নাভিরাম সব জায়গায়। ঋতুপর্ণ ঘোষ,অঞ্জন দত্ত, গৌতম ঘোষ, সন্দীপ রায়, কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের সাম্প্রতিক ছবিগুলিতে প্রবল ভাবে উঠে এসেছে উত্তরবঙ্গের চা-বাগান, জঙ্গল, পাহাড়ি পথঘাট, বনবাংলো। ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘খেলা’ ছবিতে ক্যামেরা ঘুরে বেড়িয়েছে বামনপোখরির বনবাংলো, গরুমারা সংলগ্ন খুনিয়া ও মূর্তির জঙ্গলে। সন্দীপ রায়ের ‘রয়্যাল বেঙ্গল রহস্য’ ছবিতে দেখানো বৈকুণ্ঠপুর ফরেস্ট। সবই মন টেনেছে দর্শকদের।
সিনেমার ওই সব দৃশ্যকে পর্যটনের প্রসারে আরও বেশি করে কাজে লাগানো যেতে পারে বলে মনে করছে ট্যুর অপারেটর সংস্থাগুলির একাংশ। কলকাতার একটি ট্যুর অপারেটর সংস্থার কর্ণধার তথা লোকেশন কনসালট্যান্ট শুদ্ধব্রত দেব জানান, জনপ্রিয় এই সব ছবিতে দেখানো উত্তরবঙ্গের নিসর্গ ব্যবহার করে ‘প্রোমোশনাল ভিডিও’ মারফত তা পর্যটকদের কাছে তুলে ধরা যেতে পারে। রাজ্যের বাঙালি পর্যটকদের কথা মাথায় রেখে তা করতে পারলে উত্তরবঙ্গ পর্যটনের লাভই হবে।
গত শতকেও ‘লালকুঠি’ বা ‘অনুসন্ধান’-এর মতো সুপারহিট ছবিতে ধরা দিয়েছিল উত্তরবঙ্গের নিসর্গ। কিন্তু সেই সময়ে তা পর্যটনের কাজে লাগানোর কথা কারও মাথায় আসেনি। শিলিগুড়ির এক ট্র্যাভেল এজেন্সির কর্ণধার সম্রাট সান্যালের মতে, তিন দশক আগেও সংবাদমাধ্যমে ট্র্যাভেল এজেন্সিগুলির বিজ্ঞাপনের এত বাড়বাড়ন্ত ছিল না। এখন কিন্তু বিজ্ঞাপনের দৌলতে মানুষ আগে থেকেই কী ভাবে যাবেন, কোথায় থাকবেন, কী কী দেখবেন তার পরিকল্পনা করে ফেলছেন। সে কথা মাথায় রেখেই এই ধরনের বিজ্ঞাপন শুরু হয়েছে।
এখন বিভিন্ন ট্যুর অপারেটর সংস্থা শু্যটিং লোকেশন ঠিক করা ও তদারকির কাজও করছে। ফলে, উৎসাহী পর্যটকেরা তাদের কাছে গেল তাঁদেরও ওই ধরনের লোকেশনে পাঠাচ্ছে তারা। যে সব পর্যটন সংস্থা শু্যটিং-এর কাজে যুক্ত নয়, তারাও পর্যটকদের আবদার মেটাতে নিজেরাই প্রয়োজনীয় খোঁজখবর নিচ্ছে। শিলিগুড়ির এক ভ্রমণ সংস্থার কর্ণধার রাজা বসু জানান, ডুয়ার্সের গরুমারা,চিলাপাতা,বক্সা এবং দার্জিলিঙে সিনেমাস্কোপ ট্যুর চালু করেছেন তাঁরা। এতে ভাল সাড়াও মিলেছে। অপর্ণা সেনের ‘মিস্টার অ্যান্ড মিসেস আইয়ার’ এবং গৌতম ঘোষের ‘মনের মানুষ’ ছবি দু’টির লোকেশন বেছে দিয়েছিল শিলিগুড়ির এই ট্যুর অপারেটর সংস্থাটি। রাজাবাবু বলেন, “সিনেমার এই অংশগুলি প্রোমোশনাল মেটিরিয়াল হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। ওয়েবসাইটে বা বিজ্ঞাপনে কোথায় কোন ছবির শু্যটিং হয়েছে, তা তুলে ধরা যেতে পারে। উত্তরবঙ্গের পর্যটনের ক্ষেত্রে তা নতুন দিশা দেখাতে পারে।’’
তবে ‘ফিল্ম ট্যুরিজম’-এর এই গোটা ভাবনাচিন্তাই মূলত বেসরকারি স্তরে রয়েছে। রাজ্য সরকারের তরফে এখনও তেমন কোনও চেষ্টা হয়নি। পর্যটন দফতরের সহকারী অধিকর্তা অম্লানজ্যোতি সাহার কথায়, “প্রচারে সিনেমার অংশ আমরা এখনও ব্যবহার করিনি। তবে এমন পরিকল্পনা নেওয়া যেতেই পারে। ভাবনাচিন্তা চলছে।”