শীতের সব্জি মিলছে গরমেও। এর ফলে অসময়ে চাষিরা যেমন দু’পয়সা লাভের মুখ দেখছেন, তেমনই ক্রেতারাও সারা বছরই টাটকা সব্জি পাচ্ছেন। ইজরায়েলে ব্যবহৃত পদ্ধতি অনুযায়ী লোহার পাইপের খঁুটির উপরে ও চারদিকে ২০০ মাইক্রনের পলিথিন দিয়ে ‘পলি-হাউস’ গড়ে চাষ, এই প্রকল্পের অন্যতম বিশেষত্ব।
জাতীয় উদ্যান মিশনের আওতায় ২০০৫-০৬ সাল নাগাদ কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার কৃষকদের এই অসময়ের সব্জি চাষের জন্য উত্সাহিত করে আসছে। প্রাথমিক ভাবে পশ্চিমবঙ্গের ১০টি জেলায় এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। পরে আরও চারটি জেলা এই প্রকল্পের আওতায় আসে। নদিয়া জেলায় মূলত রানাঘাট ২, হাঁসখালি, নাকাশিপাড়া, কৃষ্ণনগর ১, তেহট্ট ও করিমপুরের দুই ব্লকের বিভিন্ন জায়গায় পলি-হাউসের মাধ্যমে সব্জি ও উন্নত প্রজাতির ফুলের চাষ হচ্ছে। লাভজনক হওয়ায় জেলার বিভিন্ন প্রান্তের চাষিরা দিন দিন এই পলি-হাউস বানিয়ে অসময়ে সব্জি ও ফুল চাষে এগিয়েও আসছেন।
বছর খানেক আগে নদিয়া জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে উন্নত কৃষি-কৌশল সম্পর্কে অবহিত করতে জেলার বিভিন্ন প্রান্তের চাষিদের মহারাষ্ট্রে পাঠানো হয়েছিল। সেখানে চাষিরা পলি-হাউসের মাধ্যমে চাষাবাদের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে ধারণা লাভ করেন। জেলার উদ্যান পালন দফতরের আধিকারিক রাহুল বারিক বলেন, “মূলত ভিন্-রাজ্য থেকে উন্নত প্রযুক্তি জেনে আসা কৃষকরাই পলি-হাউসের মাধ্যমে চাষ করছেন।”
পলি-হাউস বানানো খরচসাপেক্ষ বলে সরকার এই প্রকল্পে প্রায় ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ভর্তুকি দিয়ে থাকে। নদিয়ায় এই মুহূর্তে প্রায় ১৬ হাজার বর্গমিটার জমিতে পলি-হাউসের মাধ্যমে অসময়ের সব্জি চাষ হচ্ছে।
কৃষিবিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, পলি-হাউস পদ্ধতিতে চারদিকে প্লাস্টিকের ছাউনি থাকায় সূর্যের তাপ সরাসরি খেতে ঢুকতে পারে না। ফলে, শীতের সব্জি গরমেও চাষ করতে অসুবিধা হয় না। এই পদ্ধতিতে জলের অপচয় ঠেকানো হয়। সার দেওয়া হয় নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে। প্লাস্টিকের চাদর থাকায় দুর্যোগের প্রকোপও অনেকটা ঠেকানো সম্ভব হয়। সব মিলিয়ে পলি-হাউস পদ্ধতিতে ফসলের অন্তত ২০ শতাংশ ফলন বেশি হয় বলে দাবি কৃষি বিশেষজ্ঞদের।
ফলে, এ রাজ্যে চাষিদের একটা অংশ এখন পলি-হাউস পদ্ধতিতে চাষ করতে শুরু করেছেন। তাঁদের বক্তব্য, শীতকালে দিন পনেরোর ব্যবধানে সমস্ত সব্জি বাজারে চলে আসে ফলে তখন সব্জির দাম কম থাকে। শীতের সময় কিছু-কিছু সব্জির দাম প্রায় পাওয়াই যায় না। নাকাশিপাড়ার কৃষিজীবী আনন্দ বিশ্বাস জানিয়েছেন, অগ্রহায়নের মাঝামাঝি টম্যাটো তুলে কেজি প্রতি ১৫-২০ টাকা দর পেতেন। কিন্তু পলি-হাউসে টম্যাটো করে জৈষ্ঠ্য মাসের প্রথম দিকে বাজারে গড়ে ৩০ টাকা করে প্রতি কেজি টম্যাটো বিক্রি করেছেন। একই কথা চাষিরা বলছেন শীতের সব্জি বলেই পরিচিত ক্যাপসিকাম নিয়েও। ফাল্গুনের মাঝামাঝি সময়ে বাজারে ক্যাপসিকাম ওঠে। সেই সময়ে ক্যাপসিকামের কেজি প্রতি গড় মূল্য থাকে ২৫ টাকা। কিন্তু পলি হাউসের মাধ্যমে চাষে ক্যাপসিকাম ওঠে জৈষ্ঠ্য নাগাদ। বাজারে কেজি প্রতি ক্যাপসিকামের দর থাকে ৬৫ টাকা।
ফুল চাষেও ভাল ফল দিচ্ছে ‘পলি হাউস’ পদ্ধতি। বিয়েবাড়ি বা অনুষ্ঠানের মঞ্চ সাজাতে ব্যবহৃত জারবেরা ফুল যেমন। সাদারণত শীতের মরসুমের এই ফুল নদিয়াতেও চাষ করেন অনেকে। কৃষ্ণনগরের অদূরে নৃসিংহপুরের বাসিন্দা অম্লানকুমার মোদক প্রায় হাজার বর্গ মিটার জমিতে ফুলের চাষ করছেন বেশ কয়েক বছর ধরে। তিনি বলেন, “প্রায় সাড়ে ন’লক্ষ টাকা খরচ করে পলি-হাউস তৈরি করেছি। সরকার অর্ধেক ভর্তুকি দিল। তার উপরে ফুলের চারা কিনতে খরচের অর্ধেক ভর্তুকি মিলেছে। চারা বোনার তিন মাস পর থেকে প্রতি দিন প্রায় পাঁচশোটা করে ফুল তুলতে পারছি। খেতে এসেই হাওড়ার ফুল ব্যবসায়ীরা মাল নিয়ে যাচ্ছেন।”
তবে রাজ্যের সমস্ত জেলাতেই যে পলি-হাউসের মাধ্যমে অসময়ের সব্জি চাষ জনপ্রিয় হচ্ছে, তা নয়। হাজার বর্গ মিটারের পলি-হাউস বানাতে চাষির খরচ হয় অন্তত ১০ লক্ষ টাকা। চাষিকে প্রথমে এই টাকা বিনিয়োগ করতে হয়। তারপরে মেলে সরকারি ভর্তুকি। কিন্তু অনেক জেলাতেই প্রান্তিক চাষিরা একলপ্তে এত টাকা বিনিয়োগ করতে পারছেন না বা চাইছেন না। যেমন মুর্শিদাবাদ জেলাতেই এই মুহূর্তে প্রায় ৪০০০ বর্গমিটার পলি-হাউস তৈরির ভর্তুকির টাকা পড়ে রয়েছে।