পশুগুলোর মুখ দেখতে পেলাম না, খেদ লাভপুরের নির্যাতিতার

রায়ের দিন আদালতে থাকতে না পারার আক্ষেপ কিছুতেই যাচ্ছে না লাভপুরের গণধর্ষিতার। শুক্রবার দুপুরে ফোনে খবরটা পেয়ে তাই ক্ষোভে ফেটে পড়ে বললেন, “রায় হয়ে গেল? অথচ পুলিশ-প্রশাসন কোনও খবরই দিল না! আগে জানলে, আদালতে চলে যেতাম। রায় শোনার পরে ওই পশুগুলোর মুখ কেমন ছিল, খুব জানতে ইচ্ছা করছে গো!”

Advertisement

অর্ঘ্য ঘোষ

লাভপুর শেষ আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:০২
Share:

রায়ের দিন আদালতে থাকতে না পারার আক্ষেপ কিছুতেই যাচ্ছে না লাভপুরের গণধর্ষিতার। শুক্রবার দুপুরে ফোনে খবরটা পেয়ে তাই ক্ষোভে ফেটে পড়ে বললেন, “রায় হয়ে গেল? অথচ পুলিশ-প্রশাসন কোনও খবরই দিল না! আগে জানলে, আদালতে চলে যেতাম। রায় শোনার পরে ওই পশুগুলোর মুখ কেমন ছিল, খুব জানতে ইচ্ছা করছে গো!”

Advertisement

এ দিনই লাভপুর গণধর্ষণ মামলায় অভিযুক্ত মাঝি-হাড়াম (মোড়ল)-সহ ১৩ জন অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করেছেন বোলপুরের অতিরিক্ত জেলা জজ সিদ্ধার্থ রায়চৌধুরী। সরকারি আইনজীবী মহম্মদ সামসুজ্জোহা বলেন, “ওই মামলায় চিকিৎসক, তদন্তকারী অফিসার এবং অন্যেরা মিলিয়ে মোট ৩১ জনের সাক্ষ্য নিয়েছে আদালত। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৬-গ ধারায় গণধর্ষণ, ৩২৩ ধারায় ইচ্ছাকৃত মারধর করা এবং ৩৪২ ধারায় বেআইনি ভাবে আটকে রাখার অভিযোগ সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত হয়েছে।” আজ, শনিবার বিচারক দোষীদের সাজা ঘোষণা করবেন বলে তিনি জানান।

২০ জানুয়ারি বীরভূমের লাভপুর থানার সুবলপুর গ্রামে ভিন্ জাতের এক যুবকের সঙ্গে সম্পর্কে রাখার ‘অপরাধে’ ওই আদিবাসী তরুণী ও তাঁর সঙ্গীকে রাতভর গাছে বেঁধে মারধর করা হয়। পর দিন সালিশি বসিয়ে দু’জনকে জরিমানা করা হয়। অভিযোগ ছিল, তরুণীর পরিবার জরিমানার টাকা দিতে না পারায় গ্রামের মাঝি-হাড়াম বলাই মাড্ডি কয়েক জন যুবককে ওই মেয়েটিকে নিয়ে ‘ফূর্তি’ করার নিদান দেন। ওই রাতেই তরুণীকে গণধর্ষণ করা হয় বলে অভিযোগ। ঘটনার কথা প্রকাশ্যে এলে তাঁকে খুন এবং গ্রামছাড়া করার হুমকিও দেওয়া হয়। ২২ তারিখ মোড়ল-সহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করেন ওই তরুণী।

Advertisement

সেই থেকে ওই তরুণী গ্রামছাড়া। সিউড়ির একটি হোমে এখনও তিনি মায়ের সঙ্গে থাকেন। শুক্রবার দিনভর ওই হোমে সাংবাদিকদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি। তবে, সকালে সুবলপুর গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, মেয়েটির মাটির চালাবাড়ি ভেঙে পড়েছে। উঠোনে গজিয়েছে আগাছা। আর যেখানে সালিশি সভা বসেছিল, সেই গাঁয়ের মোড়ল বলাই মাড্ডির বাড়িতে কারও দেখা মিলল না। বাড়ির ভিতরে বাসনপত্র সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে। এ দিন সকাল থেকেই গোটা গ্রাম ঘিরে ছিল উৎকণ্ঠা আর আশঙ্কা। গ্রামে কোনও পুরুষেরই দেখা মেলেনি। মহিলারা জানালেন, কেউ কেউ আদালতে গিয়েছেন। বাকিরা মাঠে। রায়ের প্রসঙ্গ তুলতেই ওই মহিলাদের বিরক্তি, “কেন বারবার এক কথা জিজ্ঞেস করেন? মন মেজাজ ভাল নেই। কোর্টে কী হয়, চিন্তায় গত রাতে ঘুম হয়নি।”

বিকেল সওয়া তিনটে নাগাদ ফোন করে কেউ রায়ের খবর দিলেন। তার পরেই ভেঙে পড়লেন পণ্ডি টুডু, হেনা মাড্ডিদের মতো গাঁয়ের বধূরা। কারও ছেলে, কারও বাবা এ দিন দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। প্রত্যকেরই দাবি, তাঁদের বাড়ির লোকেদের ফাঁসানো হয়েছে। একই দাবি করলেন মোড়লের বৃদ্ধা মা পাকু মাড্ডিও।

কিন্তু, রায়ের ব্যাপারে নির্যাতিতাকে কেন খবর দেওয়া হয়নি? জবাব দেননি জেলার এসপি অলোক রাজোরিয়া। শুধু বলেন, “সংবাদমাধ্যমে মন্তব্য করব না।” এই আট মাসেও মেয়েটিকে বাড়ি ফেরানোর ব্যবস্থা করা হয়নি। সুবলপুরের পাশের গ্রামে সরকারের বানিয়ে দেওয়া বাড়িতেও তিনি যাননি। নির্যাতিতা অবশ্য ফিরতে চান নিজের গ্রামেই। তাঁর কথায়, “পুলিশ জানিয়েছিল, অভিযুক্তেরা সাজা পেলেই বাড়ি ফেরানো হবে। তাই ইচ্ছে থাকলেও ফিরতে পারছি না।” এ বার কি তাহলে তাঁকে গ্রামে ফেরানোর ব্যবস্থা করা হবে? জেলাশাসক পি মোহন গাঁধী বলেন, “মেয়েটি যখনই চাইবেন, আমরা তাঁকে ফেরানোর ব্যবস্থা করব।”

আতঙ্ক কিন্তু কাটেনি নির্যাতিতার। বলছেন, “সেই রাতটার কথা কিছুতেই ভুলতে পারি না। ওদের সবার যাবজ্জীবন সাজা হলেই শান্তি পাব।”

(সহ-প্রতিবেদন: মহেন্দ্র জেনা)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন