বিক্ষোভের আঁচে এ বার রং বদল শালিমারে

অশান্তির আঁচ ঢুকে আগে কখনও ফাটল ধরেনি। রাজনীতির রং-ও এত দিন কার্যত ছাপ ফেলতে পারেনি। কিন্তু দরজায় কাজ বন্ধের নোটিস ঝুলতেই ছবিটা রাতারাতি পাল্টে গেল হাওড়ার শতাব্দী-প্রাচীন রং কারখানা শালিমার পেন্টস-এ। বৃহস্পতিবার দুপুর থেকেই কারখানা চত্বর সরগরম। মূল ফটকে রাজ্যের শাসকদলের শ্রমিক সংগঠনের পতাকা ঝুলিয়ে জোরদার শ্রমিক বিক্ষোভ।

Advertisement

দেবাশিস দাস

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ জুলাই ২০১৪ ০৩:১৭
Share:

উদ্বেগ। কারখানার গেট থেকে উঁকি আটকে পড়া শ্রমিক পরিবারের সদস্যদের। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার।

অশান্তির আঁচ ঢুকে আগে কখনও ফাটল ধরেনি। রাজনীতির রং-ও এত দিন কার্যত ছাপ ফেলতে পারেনি। কিন্তু দরজায় কাজ বন্ধের নোটিস ঝুলতেই ছবিটা রাতারাতি পাল্টে গেল হাওড়ার শতাব্দী-প্রাচীন রং কারখানা শালিমার পেন্টস-এ।

Advertisement

বৃহস্পতিবার দুপুর থেকেই কারখানা চত্বর সরগরম। মূল ফটকে রাজ্যের শাসকদলের শ্রমিক সংগঠনের পতাকা ঝুলিয়ে জোরদার শ্রমিক বিক্ষোভ। কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে কারখানার কয়েক জন প্রশাসনিক আধিকারিক। তাঁদের কপালে ভাঁজ। চিন্তা কারখানা-চত্বরের আবাসনে কার্যত আটকে পড়া কিছু ম্যানেজমেন্ট কর্মী ও তাঁদের পরিজনদের নিয়ে। শ্রমিক-অসন্তোষের দরুণ যাঁরা বেরিয়ে আসার সাহস পাচ্ছেন না।

অভিযোগ, রং কারখানাটির ভিতরে এই মুহূর্তে এমন প্রায় ৩০টি কর্মী-পরিবার আটকে রয়েছেন। শালিমার পেন্টস কারখানার কর্মিবর্গ (পার্সোনেল) বিভাগের ম্যানেজার সঞ্জীব মজুমদারের এ দিন দাবি, “ভিতরে আটকে থাকা পরিবারগুলোর অবস্থা শোচনীয়। তাঁদের রেশনও ফুরিয়ে গিয়েছে।” তৃণমূল শ্রমিক সংগঠনের নেতা দেবাশিস সেন অবশ্য অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন। “ভিতরে হাতে গোনা ক’টি পরিবার রয়েছে। আমরা তাঁদের আটকে রাখিনি। ইচ্ছে করলেই তাঁরা বাইরে বেরোতে পারেন।” বলছেন তিনি।

Advertisement

ঘটনা হল, ইউনিয়ন নেতার আশ্বাসবাণীতেও ভরসা পাচ্ছেন না কর্মীরা। পুলিশ-প্রশাসন যতক্ষণ না পাশে এসে দাঁড়ায়, ততক্ষণ গেটের বিক্ষোভ-বেড়া ডিঙিয়ে বাইরে আসার ঝুঁকি নিতে পারছেন না। বিশেষত সম্প্রতি শ্রমিক অসন্তোষের জেরে ভদ্রেশ্বরে নর্থব্রুক জুটমিলের সিইও খুনের ঘটনা বইয়ে দিয়েছে আশঙ্কার চোরাস্রোত। উপরন্তু এ দিন সকালে কারখানার এক নিরাপত্তারক্ষীকে কয়েক জন শ্রমিক মিলে মারধর করেছেন বলে অভিযোগ।

উত্তেজনার এ হেন আবহে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সঞ্জীববাবু প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়েছেন। জেলা প্রশাসন যদিও আশঙ্কার কিছু দেখছে না। এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে হাওড়ার জেলাশাসক শুভাঞ্জন দাশ এ দিন বলেন, “কারখানার ভিতরে লোকজন আটকে থাকার কথা ম্যানেজমেন্টের তরফে কেউ আমাদের জানাননি।” তবে কারখানার বাইরে বেআইনি জমায়েতের জেরে উত্তেজনা ছড়ানোর খবর তাঁর কানে এসেছে বলে ডিএম জানিয়েছেন। পুলিশ-কর্তৃপক্ষও নিরাপত্তার আশ্বাস দিচ্ছেন। জেলা পুলিশের কর্তাদের দাবি, পরিস্থিতির উপরে নজর রাখা হচ্ছে। কিন্তু ভিতরের লোকদের বাইরে আনার জন্য এখনই তাঁরা বলপ্রয়োগের কথা ভাবছেন না। “চেষ্টা চলছে, যাতে দু’পক্ষে সমঝোতা করিয়ে সমস্যার একটা সমাধান-সূত্র পাওয়া যায়।” মন্তব্য এক পুলিশ-কর্তার।

প্রশাসন উত্তেজনার খবর পেয়েছে। পুলিশ ধৈর্য ধরতে চাইছে। এর মধ্যে বন্ধ কারখানা-চত্বরের হাওয়া হয়ে উঠেছে গনগনে। এ দিনের বিক্ষোভ সমাবেশে শ্রমিক নেতারা ঘোষণা করেছেন, যত দিন না শালিমারের ফটক খুলছে, তত দিন তাঁরা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। অন্য দিকে এত দিনের উপার্জনের উৎস আচমকা ঝাঁপ ফেলায় শ্রমিক-কর্মচারীরা দিশেহারা। সামনেই খুশির ঈদ। তার দু’মাস বাদে শারোদৎসব। উৎসবের মরসুমের মুখে কারখানায় তালা পড়ে যাওয়ায় শ্রমিকদের ঘরে ঘরে এখনই বিসর্জনের সুর। শালিমার-কর্মী শিশির মিত্র ও তাঁর স্ত্রী অমিতা যেমন বলছিলেন, “অনেক কষ্ট করে ছেলেটাকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে পাঠিয়েছি কোলাঘাটে। বুঝতে পারছি না, পড়ার খরচ কোথা থেকে জোগাব। আমাদের সব কিছুই তো ছিল এই কারখানা!” আর এক কর্মী মহম্মদ আয়ুবের আক্ষেপ, “এ ভাবে সব

শেষ হয়ে যাবে, স্বপ্নেও ভাবিনি।” তিনি মঙ্গলবার রাতের শিফ্ট শেষ করে কাকভোরে বাড়ি ঢুকে চোখটা সবে বন্ধ করেছিলেন। দুঃসংবাদের ধাক্কায় সেই যে ঘুম উড়ে গিয়েছে, আর আসেনি।

শালিমার পেন্টসের দরজায় তালা আর নোটিস দেখে ওঁদের মতো অনেকেরই মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ছে। বস্তুত অনিশ্চয়তা গ্রাস করেছে গোটা মহল্লাকেই। তামাম ওই তল্লাটের জীবনযাত্রার ভরকেন্দ্র ছিল শালিমার পেন্টস। কারখানায় তালা ঝোলায় সেই ভরকেন্দ্রই নড়ে গিয়েছে। কারখানার উল্টো দিকে বিরাট বাজার রং কল বাজার। সেখানকার দোকানদারদের মাথায় হাত। ওঁদের খদ্দের তো সব কারখানার লোক! খদ্দেরের পকেটে টান পড়লে ব্যবসা চলবে কী করে, তার উত্তর মিলছে না। কারখানায় কাঁচামাল খালাস করতেন যে সব ঠিকা-শ্রমিক, তাঁরাও এ দিন সকাল থেকে পরিবার-পরিজন নিয়ে গেটের সামনে জড়ো হয়েছিলেন একরাশ দুশ্চিন্তা সঙ্গী করে। শ্রমিক-পরিবারের শাহিদা, সুলতানাদের প্রশ্ন, “বেশির ভাগ বাড়িতে কাল রাতে হাঁড়ি চড়েনি। একটা কিছু উপায় না-হলে কোথায় গিয়ে দাঁড়াব বলতে পারেন?”

সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই বহু পরিবার বংশানুক্রমে শালিমার পেন্টসের কর্মী। ওঁদের দাবি, কারখানা-কর্তৃপক্ষের সঙ্গে শ্রমিক-কর্মীদের তেমন কোনও তিক্ততা ছিল না। বরং তাঁরা এক পারিবারের মতো ছিলেন। যে কারণে রং কারখানার গেটে

আগে কখনও রাজনৈতিক রংয়ের পতাকা দেখা যায়নি। “শ’দুয়েক মানুষ মিলে-মিশে এতগুলো বছর কাটিয়েছি! মার্চে কারখানায় আগুন লাগল যখন, হাতে হাত মিলিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছি।” সন্ধ্যার আধো অন্ধকারে শত বছর উত্তীর্ণ প্রতিষ্ঠানের সামনে দাঁড়িয়ে বিষণ্ণ সুরে স্মৃতিচারণ করেন এক প্রৌঢ় শ্রমিক।

কারখানাটা কেন যে বন্ধ হয়ে গেল, তা ওঁদের মাথায় ঢুকছে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন