বিভ্রান্ত করছে আলিমার বাড়ি, দাবি গোয়েন্দাদের

বর্ধমান বিস্ফোরণ কাণ্ডের জেরে মুর্শিদাবাদ জেলা গোয়েন্দা দফতর সন্দেহজন দু’জনকে হন্যে হয়ে খুঁজছে। ওই দু’জনেই মুর্শিদাবাদ জেলার বাসিন্দা। এক জনের বাড়ি বেলডাঙা থানা এলাকায়, অন্য জনের বাড়ি সামশেরগঞ্জ এলাকায়। গোয়েন্দা দফতর সূত্রের খবর, ওই দু’জন ধরা পড়লে বর্ধমানে কাণ্ডের তদন্তের কাজ অনেকটাই গুটিয়ে আনা সম্ভব হবে।

Advertisement

শুভাশিস সৈয়দ ও সেবাব্রত মুখোপাধ্যায়

বহরমপুর ও বেলডাঙা শেষ আপডেট: ০৯ অক্টোবর ২০১৪ ০২:৪৬
Share:

বেলডাঙায় শাকিলের কারখানার সামনে পুলিশি প্রহরা।—নিজস্ব চিত্র।

বর্ধমান বিস্ফোরণ কাণ্ডের জেরে মুর্শিদাবাদ জেলা গোয়েন্দা দফতর সন্দেহজন দু’জনকে হন্যে হয়ে খুঁজছে। ওই দু’জনেই মুর্শিদাবাদ জেলার বাসিন্দা। এক জনের বাড়ি বেলডাঙা থানা এলাকায়, অন্য জনের বাড়ি সামশেরগঞ্জ এলাকায়। গোয়েন্দা দফতর সূত্রের খবর, ওই দু’জন ধরা পড়লে বর্ধমানে কাণ্ডের তদন্তের কাজ অনেকটাই গুটিয়ে আনা সম্ভব হবে। প্রাথমিক তদন্তে জেলা গোয়েন্দাদের দাবি, গোটা ঘটনায় ওই দু’জনই মূল পাণ্ডা। তাদের সাহায্য ছাড়া আবদুল হাকিম বা শাকিল আহমেদের মুর্শিদাবাদ জেলায় ডেরা বাঁধা সম্ভব ছিল না। সেই সঙ্গে নবগ্রামের আলিমা বিবির পরিবারের কয়েক জন সদস্যও গোয়েন্দাদের সন্দেহের তালিকায় রয়েছে। ফলে ঘটনার পর থেকেই ওই পরিবারের সদস্যদের দফায় দফায় জেরা চলছে। কখনও রাজ্য গোয়েন্দা দফতর, কখনও জেলা গোয়েন্দা দফতরের অফিসাররা তালডহরা গ্রামে গিয়ে আলিমার পরিবারের সদস্যদের জেরা করে প্রকৃত ঘটনা উদ্ধারের চেষ্টা করছেন।

Advertisement

জেলা গোয়েন্দা দফতরের এক আধিকারিক বলেন, “আলিমার পরিবার সঠিক তথ্য দিচ্ছে না। কেননা, আলিমার বিয়ের সময়ে তার বড় দাদা সিকান্দার আলি উপস্থিত ছিলেন, যিনি রানিতলা থানার হোসেননগর মাদ্রাসায় পড়ান। ২০১১ সালে ওই বিয়ের পরেই আলিমার মেজ দাদা ও এক ভাই উত্তরপ্রদেশের খাইরুল উলুম নামে এক মাদ্রাসায় পড়তে চলে যায়। উত্তরপ্রদেশের ওই মাদ্রাসায় পড়তে পাঠানোর পিছনে আবদুল হাকিমের কোনও সংযোগ রয়েছে কি না, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ওই বিয়েতে তারা কেউ হাজির ছিল না বলে অবশ্য আলিমার পরিবার জানায়। এছাড়াও ওই পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা জানারও চেষ্টা চলছে।”

এদিকে ঘটনার পরেই তদন্তে বেলডাঙায় গিয়ে জেলা গোয়েন্দা দফতরের অফিসাররা জানতে পারেন, চারটি ঘর ভাড়া নিয়ে চারটে পরিবার থাকত। তার মধ্যে দু’জন বর্ধমান বিস্ফোরণে মারা যায়। আবদুল হাকিম আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। বাকিদের খোঁজে সন্ধান চলছে। তবে ওই চারটি পরিবারই বিস্ফোরণের ছ’মাস আগে থেকেই বেলডাঙায় বাস করত না বলেই জানিয়েছে গোয়েন্দা দফতর। দোকান ঘর-সহ অন্য ঘরগুলি তালাবন্ধ ছিল। বন্ধ তালা খুলে ভেতরে ঢুকতেই জেলা গোয়েন্দা দফতরের অফিসাররা তাজ্জব বনে যান। অফিসারদের কথায়, ঘরের মধ্যে বারুদের স্তুুপ ছিল। কোনও ভাবে বস্তাবন্দি মজুত ওই বারুদ থেকে বড় আকারের বিস্ফোরণ ঘটে যেতে পারত। সেক্ষেত্রে জনবহুল ওই এলাকায় বড় ধরণের দুর্ঘটনা ঘটতে পারত। ওই বারুদের স্তূপ দেখে জেলা গোয়েন্দা দফতরের এক শীর্ষকর্তা বলেন, “বেলডাঙায় বোরখা তৈরির নামে তারা যে চারটি ঘরে ভাড়া নিয়ে বাস করত সেখানেই বারুদ মজুত করত। পরে সেখান থেকে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে সরবরাহ হত বলেই অনুমান।” ওই বারুদের পাশাপাশি প্রায় ৭০০ থেকে ৮০০ ধর্মীয় পুস্তিকা। তবে বেলডাঙায় মূলত বোরখা, আধা বোরখা, হাত মোজা ও মুখ ঢাকার জন্য স্কার্ফ তৈরি হত। যে ঘরে বোরখা তৈরি হত সেখানে ৬ অক্টোবর থেকে পুলিশ পিকেট বসানো হয়েছে।

Advertisement

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানাচ্ছেন, ওই বোরখা তৈরির ঘরে দু’জন কমবয়সী মহিলা ও পুরুষ সব থেকে বেশি যাতায়াত করতেন। ওই মহিলাদের মুখ সবসময় বোরখায় ঢাকা থাকত। সারা দিনে এক থেকে দু’ঘণ্টা সেলাই মেশিন চলত। রাত ১১ টার পরে ঘরে কোনও আলো জ্বলত না। তবে রাতে মাঝেমধ্যে অদ্ভুত কিছু শব্দ পাওয়া যেত বলে জানান ওই এলাকার বাসিন্দারা।

শাকিল কীভাবে বেলডাঙায় জমিয়ে বসেছিল? গোয়েন্দা সূত্রে জানা গিয়েছে, বেলডাঙার মেদেরধারের বাসিন্দা ইউসুফ বোরখার ব্যবসা করতেন। সেই ব্যবসার সুবাদেই দু’জনের আলাপ। ইউসুফ তার ভাইয়ের জন্য একটা দোকানঘর নিয়েছিল। পরে সেই ঘরটিই ব্যবসার জন্য সে শাকিলকে দেয়। গোয়েন্দারা ইউসুফকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদও করে। স্থানীয় বাসিন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে গোয়েন্দারা জানতে পারেন, ওই পরিবারের পুরুষ সদস্যরা প্রতি দিন মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নমাজ পড়তে গেলেও কারও সঙ্গে কোনও কথা বলত না। এমনকী নমাজ পড়ার সময়ে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে বা রাস্তায় যাতায়াত পথেও কারও সঙ্গে কথা হত না। মাথা নিচু করে যাতায়াত করত। মহিলাদের মুখ সব সময়ে বোরখায় ঢাকা থাকত। তবে জনবহুল এলাকায় দোকান হওয়ায় সেখানে কারা কখন যাওয়া-আসা করছে সেটা তেমন ভাবে কেউ খেয়াল করতেন না।

গোয়েন্দা দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, বেলডাঙার বাড়ির মালিক আমিনুল শেখ গোয়েন্দাদের জানান, মসজিদের মৌলনা আমাকে ওই বাড়ি ভাড়া দেওয়ার কথা বলেছিল। পরে গোয়েন্দারা স্থানীয় মসজিদের ওই মৌলনাকেও জেরা করেন। ওই মৌলনা গোয়েন্দাদের জানান, বেলডাঙার মাদ্রাসায় অনেকেই ধর্মীয় শিক্ষার পরীক্ষা দিতে আসে। তারা পড়াশোনার জন্য ঘর ভাড়া নিয়ে থাকেন। ওই তিন জন আসে। তখন তাদের ওই ঘরের সন্ধান দিই। ওই মৌলনা কিন্তু তার বেশি কিছু তথ্য দিতে পারেননি।

জেলা গোয়েন্দা দফতরের অন্য এক শীর্ষকর্তা বলেন, “ঘর ভাড়া নেওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই স্বাভাবিক যে পাঁচিল ছিল, ভাড়াটিয়ারা আরও তিন ফুট উচ্চতা বাড়িয়ে নেন। যাতে লোকচক্ষুর আড়ালে কাজ করা সম্ভব হয়। সেই সঙ্গে ফোনের কল্ ডিটেলস্ থেকে সন্দেহজনক ব্যক্তিদের তালিকা তৈরির চেষ্টা হচ্ছে। সময় মত তাদেরও জেরা করা হবে।” তবে বেলডাঙা ও সামশেরগঞ্জের সন্দেহজনক দুজনকে এখড় হাতের নাগালে পেতে মরিয়া জেলা ও রাজ্য গোয়েন্দা দফতর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন