নিজেদের তৈরি আবাসন নীতি বদলে ফেলছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। গরিবদের বাড়ি তৈরিতে আর্থিক অনুদানের পরিমাণ কমিয়ে তা বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চাইছে রাজ্য। প্রশাসনের একাংশের অবশ্য বক্তব্য, ২০১৬ সালে পরবর্তী বিধানসভা নির্বাচনকে নজরে রেখেই রাজ্য সরকার এই নীতি বদলের পরিকল্পনা নিয়েছে। এর ফলে ভোটের আগে বাড়ি তৈরির নামে বেশ কিছু মানুষের হাতে থোক ৭০ হাজার টাকা করে ধরিয়ে দেওয়া যাবে।
নতুন নীতিতে গীতাঞ্জলি নামে চালু প্রকল্পটির ধাঁচ বদলে ফেলা হচ্ছে। গরিব মানুষকে পাকা বাড়ি তৈরি করে দেওয়ার জন্য এই প্রকল্পে বর্তমানে ১ লক্ষ ৭৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এ বার থেকে বাড়ি পিছু ৭০ হাজার টাকা দেবে সরকার। সেই সঙ্গে শিথিল করা হচ্ছে গ্রাহক বাছাইয়ের প্রক্রিয়া ও টাকা পাওয়ার শর্তও।
আবাসন দফতর সূত্রের খবর, এত দিন গীতাঞ্জলি প্রকল্পে পাকা বাড়ি তৈরির জন্য ১ লক্ষ ৭৫ হাজার টাকা দেওয়া হত। পাহাড় অথবা দুর্গম এলাকায় অনুদান ছিল আরও ১ লক্ষ টাকা বেশি। এই প্রকল্পে বাড়ি তৈরির জন্য গ্রাহক বাছাই করত ১৪টি দফতর। বাড়ি তৈরি হতো ঠিকাদার নিয়োগ করে। এখন বাড়ি-পিছু বরাদ্দ কমিয়ে করা হচ্ছে ৭০ হাজার টাকা। বাড়ি তৈরির ভারও আর ঠিকাদারের হাতে রাখা হচ্ছে না। কেন্দ্রীয় সরকারি প্রকল্প ইন্দিরা আবাস যোজনাতেও বাড়ি তৈরির জন্য ৭০ হাজার টাকা করেই দেওয়া হয়। এর সঙ্গে ছিল, মুখ্যমন্ত্রীর নামকরণ করা আরও একটি প্রকল্প ‘আমার ঠিকানা’। অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ায় সেটিও বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে।
পরিবর্তন আরও কিছু হচ্ছে। গীতাঞ্জলি প্রকল্পে বিভিন্ন দফতরের হাত থেকে সরিয়ে গ্রাহক বাছাইয়ের ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে জেলাশাসকদের। টাকাও এখন থেকে ঠিকাদারদের বদলে গ্রাহকদের হাতে সরাসরি দেওয়া হবে দু’টি কিস্তিতে। ওই টাকায় সত্যিই বাড়ি হল কি না, তা দেখবেন ব্লক স্তরের অফিসারদের। যদিও যে সব বাড়ির নির্মাণ ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে, তাদের টাকা পুরনো নিয়মেই মেটাবে আবাসন দফতর।
এক আবাসন কর্তার মতে, নয়া ব্যবস্থায় চার ধরনের সুবিধা হবে।
১) বাড়ি-পিছু বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়ায় এখন সম-পরিমাণ টাকায় প্রায় আড়াই গুণ বেশি পরিবারকে পাকা বাড়ি তৈরি করে দেওয়া যাবে।
২) বিপিএল তালিকায় নাম নেই, এমন হতদরিদ্র মানুষদেরও গীতাঞ্জলি প্রকল্পে বাড়ি বানিয়ে দেওয়া যাবে।
৩) ঠিকাদার নিয়োগের ব্যবস্থা রদ হওয়ায় পুরো বরাদ্দই গ্রাহকদের হাতে পৌঁছবে।
৪) বিভিন্ন দফতরের বদলে জেলাশাসকদের হাতে গ্রাহক বাছাইয়ের দায়িত্ব যাওয়ায় প্রকল্প রূপায়ণে গতি বাড়বে।
কিন্তু সরকারের এই নতুন সিদ্ধান্তে টাকা নয়ছয়ের সুযোগ রয়েছেন বলে মনে করছে প্রশাসনের একাংশ। কী রকম? তাঁদের মতে, সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এখন বাড়ি তৈরির টাকা সরাসরি গ্রাহকের হাতে তুলে দেওয়া হবে। সেই টাকায় সত্যিই বাড়ি তৈরি হয়েছে কি না, তা দেখবেন ব্লক স্তরের অফিসারেরা। এই ব্যবস্থার মধ্যেই নয়ছয়ের সুযোগ রয়েছে। নবান্নের এক কর্তা জানান, রাজ্যের অধিকাংশ পঞ্চায়েত শাসক দলের হাতে থাকায় গ্রাহক বাছাইয়ের ক্ষেত্রে পক্ষপাতিত্ব হওয়ার সুযোগ থাকছে। একই কারণে বাড়ি না করেও ব্লক অফিসারদের থেকে শংসাপত্র পেতে অসুবিধা নাও হতে পারে। বাড়ি হোক না হোক, ভোটের আগে গরিব মানুষ ৭০ হাজার টাকা হাতে পেলে শাসক দল বাড়তি সুবিধা পাবে বলেই মনে করা হচ্ছে।
দফতরের শীর্ষ কর্তা জানাচ্ছেন, গীতাঞ্জলি প্রকল্পে ২০১৩-১৪ সালে ৫২৮ কোটি টাকা খরচ করে ৩৪ হাজার ৪৭৬টি বাড়ি তৈরি করা হয়েছে। ২০১৪-১৫ আর্থিক বছরে বাজেটে এই খাতে ৬০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। নতুন বাড়ি তৈরি হবে ৪০ হাজার। আর গত বছরে নির্মাণ শুরু হয়েছে, এমন ৩০ হাজার বাড়ির দ্বিতীয় কিস্তির টাকাও মেটানো হবে। কিন্তু পরের আর্থিক বছরে, অর্থাৎ বিধানসভা নির্বাচনের বছরে এই সংখ্যা অনেকটাই বেড়ে যাবে। আর সরকারের উদ্দেশ্য সেটাই বলে মনে করা হচ্ছে।
আবাসনমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস এই ব্যাপারে কিছু বলতে চাননি। তাঁর কথায়, “বিধানসভায় বাজেট অধিবেশন চলছে। যা বলার সভাতেই বলব।” তবে আবাসন দফতরের এক কর্তা জানান, গরিব মানুষের জন্য গীতাঞ্জলি, আমার ঠিকানা, অধিকার এবং ইন্দিরা আবাস যোজনা এই চারটি সরকারি আবাসন প্রকল্প রয়েছে। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের ইন্দিরা আবাস যোজনায় বাড়ি তৈরির জন্য ৭০ হাজার টাকা দেওয়া হয় কেবল বিপিএল তালিকাভুক্তদের। কিন্তু গীতাঞ্জলি প্রকল্পে রাজ্য সরকার বিপিএল বা তার বাইরের যে কোনও গরিব মানুষের জন্য বাড়ি তৈরিতে টাকা দিত। ফলে গীতাঞ্জলির বাড়ি পেতেই গ্রাহকদের আগ্রহ ছিল বেশি। সেই কারণে গত তিন বছরে ইন্দিরা আবাস প্রকল্পটি রাজ্যে সাফল্য পায়নি। গীতাঞ্জলি প্রকল্পে আরও বেশি মানুষের বাড়ি তৈরি করে দেওয়ার জন্য যত টাকা দরকার, রাজ্যের পক্ষে তা বরাদ্দ করা সম্ভব হয়নি। তাই ইন্দিরা আবাসের আদলেই গীতাঞ্জলি প্রকল্পটিকে বদলে ফেলা হল। এর ফলে বাড়ি তৈরির প্রকল্পগুলির মধ্যে সামঞ্জস্য আসবে।
পঞ্চায়েত মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “এর ফলে সরকারি প্রকল্পে বাড়ি পেতে আবার পঞ্চায়েত অফিসে লাইন পড়বে।” তিনি জানান, ২০১৪-১৫ সালে ইন্দিরা আবাস প্রকল্পে এ রাজ্যে বাড়ি তৈরির জন্য ৩০৩০ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। সেই টাকায় ৪ লক্ষ ৩৩ হাজার পাকা বাড়ি তৈরি করা যাবে। সেই সঙ্গে যুক্ত হবে গীতাঞ্জলি প্রকল্পের ৬০০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে সরকারি সহায়তায় আগের চেয়ে অনেক বেশি মানুষকে বাড়ি তৈরি করে দেওয়া যাবে।