বছর ঘুরল, হাইকোর্টে সেই মামলা তিমিরেই

সিবিআই-তদন্ত চেয়ে আবেদন দাখিলের পুরো এক বছর পেরোয়নি, সুপ্রিম কোর্ট সারদা-মামলার চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করে দিল। অথচ একই আর্জি জানিয়ে কলকাতা হাইকোর্টে দায়ের করা জনস্বার্থ-মামলাটির চূড়ান্ত শুনানি শেষ হল না একটা বছর ঘুরে গেলেও। আইনজীবী মহলের একাংশের মতে হাইকোর্ট প্রথমে যথাযথ গুরুত্ব দিলে সারদা-কাণ্ডে সিবিআই-তদন্ত আগেই শুরু হতে পারত।

Advertisement

অরুণোদয় ভট্টাচার্য

কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ মে ২০১৪ ০৩:৩৮
Share:

সিবিআই-তদন্ত চেয়ে আবেদন দাখিলের পুরো এক বছর পেরোয়নি, সুপ্রিম কোর্ট সারদা-মামলার চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করে দিল। অথচ একই আর্জি জানিয়ে কলকাতা হাইকোর্টে দায়ের করা জনস্বার্থ-মামলাটির চূড়ান্ত শুনানি শেষ হল না একটা বছর ঘুরে গেলেও। আইনজীবী মহলের একাংশের মতে হাইকোর্ট প্রথমে যথাযথ গুরুত্ব দিলে সারদা-কাণ্ডে সিবিআই-তদন্ত আগেই শুরু হতে পারত।

Advertisement

২০১৩-র ২৩ এপ্রিল সোনমার্গে ধরা পড়েন সারদা-কর্ণধার সুদীপ্ত সেন ও দেবযানী মুখোপাধ্যায়। এক সপ্তাহের মধ্যে, ৩০ এপ্রিল সারদা-কাণ্ডে সিবিআই-তদন্ত চেয়ে জনস্বার্থ-মামলা দায়ের হয় কলকাতা হাইকোর্টে। মামলা করেছিলেন আইনজীবী বাসবী রায়চৌধুরী। মামলাটিকে যাতে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়, সে জন্য তাঁর কৌঁসুলি সুব্রত মুখোপাধ্যায় প্রধান বিচারপতি অরুণ মিশ্রের ডিভিশন বেঞ্চে বারবার আবেদন করেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, গরিব মানুষের কাছ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুঠ হয়েছে, প্রতারিতদের মৃত্যু-মিছিল চলছে।

এত বড় একটা কেলেঙ্কারির তদন্ত একমাত্র সিবিআই-ই করতে পারে বলে প্রধান বিচারপতির বেঞ্চে সওয়াল করেন সুব্রতবাবু।

Advertisement


সবিস্তার দেখতে ক্লিক করুন

সরকারপক্ষ অবশ্য গোড়া থেকে সিবিআই তদন্তের প্রস্তাবে আপত্তি জানিয়ে এসেছে। পরে একটা সময়ে দীর্ঘ দিন মামলার শুনানি বন্ধ থাকে। শেষমেশ পর্যন্ত সুব্রতবাবু ডিভিশন বেঞ্চকে বলেন, মামলা খারিজ করে দেওয়া হোক, কারণ তা হলে তিনি সুপ্রিম কোর্টে যেতে পারবেন। প্রধান বিচারপতি অরুণ মিশ্র তখন মামলাটিকে বিচারপতি অসীম বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডিভিশন বেঞ্চে পাঠিয়ে দেন।

হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ আগে গুড়াপের হোম-হত্যা, ধনেখালির নিজামুদ্দিন হত্যা বা মদন তামাং খুনের তদন্তে সিবিআই ডেকেছে। অথচ সারদার মতো এমন গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল একটা মামলা কেন দীর্ঘ দিন শুনানি না-করে ফেলে রেখে অন্য বেঞ্চে পাঠিয়ে দেওয়া হল, তার যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা সুব্রতবাবুরা খুঁজে পাননি। “কলকাতা হাইকোর্ট তখনই ব্যবস্থা নিলে এতগুলো মানুষকে এত দিন ধরে হয়রান হতে হতো না। সিবিআই-তদন্তের জন্য সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ারও দরকার পড়ত না।” শুক্রবার মন্তব্য করেন সুব্রতবাবু।

হাইকোর্টের আইনজীবীদের একাংশও তাঁর সঙ্গে একমত। উপরন্তু ওঁদের অনেকের চোখে পাড়ুই-মামলার গতি-প্রকৃতির সঙ্গে এর মিল ধরা পড়েছে। প্রসঙ্গত, সারদা-কেলেঙ্কারিতে সিবিআই-তদন্তের আর্জি নিয়ে গত বছরের ২০ মে সুপ্রিম কোর্টে জনস্বার্থ-মামলা দায়ের করেছিলেন এ রাজ্যের তিন আইনজীবী প্রতিম সিংহরায়, আবু আব্বাসউদ্দিন ও সুব্রত চট্টরাজ। ওঁদের উদ্যোগের নেপথ্যে ছিলেন প্রদেশ কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নান। গত ১৬ এপ্রিল মামলার শুনানি শেষ হয়। আর এ দিন শীর্ষ আদালতের চূড়ান্ত রায়ে সারদা-কাণ্ডে সিবিআই-তদন্তের নির্দেশ শুনে হাইকোর্টের আইনজীবীদের অনেকের অভিমত, এতে কলকাতা হাইকোর্টের সুনাম কিছুটা ক্ষুণ্ণই হল।


সবিস্তার দেখতে ক্লিক করুন

কিন্তু হাইকোর্টে বেঞ্চবদলের পরে বাসবীদেবীর জনস্বার্থ-মামলার পরিণতি কী? বিচারপতি অসীম বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডিভিশন বেঞ্চেও সুব্রতবাবু বারবার সিবিআই-তদন্তের আর্জি জানান। বলেন, এই আর্থিক কেলেঙ্কারির জাল পশ্চিমবঙ্গের গণ্ডি ছাড়িয়ে বেশ কয়েকটি রাজ্যে বিস্তৃত। তাই পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের পক্ষে তদন্ত করা সম্ভব নয়। সিবিআইয়ের তরফে হাইকোর্টকে জানানো হয়, রাজ্য সরকার লোকজন ও গাড়ির ব্যবস্থা করলে তারা সারদা-তদন্তের দায়িত্ব নিতে তৈরি। এ দিকে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের (ইডি) কৌঁসুলি সোমনাথ বসু সওয়ালে জানান, মানি লন্ডারিং আইনে সারদার সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত, বিক্রি ইত্যাদির এক্তিয়ার একমাত্র তাদেরই রয়েছে। রাজ্য সরকারের গড়া শ্যামল সেন কমিশনের এমন কোনও ক্ষমতা নেই বলে দাবি করে ইডি’র কৌঁসুলি আবেদন করেন, তদন্তভার তাঁদের হাতে ন্যস্ত হোক। আবার কেন্দ্রীয় সিরিয়াস ফ্রড ইনভেস্টিগেশন অফিস (এসএফআইও)-এর দাবি ছিল, এ জাতীয় আর্থিক কেলেঙ্কারির তদন্ত করার দায়িত্ব তাদেরই। সারদা-কাণ্ডের মতো আর্থিক প্রতারণার মামলায় ইডি বা এসএফআইও এমনিতেই সামিল হয়। বিধাননগর কমিশনারেটের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা মিলছে না মূলত এই নালিশ নিয়ে ইডি হাইকোর্টে গিয়েছিল। সেই সূত্রেই জনস্বার্থ-মামলার শুনানিতে তারা নিজেদের বক্তব্য পেশ করে।

সব পক্ষের বক্তব্য শুনে বিচারপতি বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডিভিশন বেঞ্চ জানিয়ে দেয়, এই মুহূর্তে তারা সিবিআই-কে সারদা-কাণ্ডের তদন্ত করতে ডাকছে না। পরে ডাকা হবে কি না, তা-ও বলছে না। তবে ইডি’কে সহযোগিতা করতে ডিভিশন বেঞ্চ রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দেয়। বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট)-কে আরও শক্তিশালী করা, শ্যামল সেন কমিশনের রিপোর্ট প্রতি মাসে হাইকোর্টে জমা দেওয়ার মতো মোট ৯ দফা নির্দেশ রাজ্য সরকারের জন্য জারি করা হয়। যদিও পরে ইডি-র তরফে একাধিক বার আদালতকে জানানো হয়, সিটের কাছ থেকে তারা কোনও সাহায্য পাচ্ছে না, কোনও নথি দেখতে দেওয়া হচ্ছে না। ফলে আইন অনুযায়ী নিজেদের কর্তব্য তারা পালন করতে পারছে না বলে হাইকোর্টে নালিশ জানায় ইডি। ইডি-কে যাবতীয় সাহায্য করতে সিট-কে নির্দেশ দেয় ডিভিশন বেঞ্চ। ইতিমধ্যে সুব্রতবাবু বিচারপতি অসীম বন্দ্যোপাধ্যায়ের বেঞ্চ থেকেও মামলাটি প্রত্যাহার করে নিতে চান।

সুপ্রিম কোর্টে সিবিআই-তদন্তের আবেদন দাখিল হওয়ার পরে বাসবীদেবীও তাতে সামিল হন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন