ভোট পারাবারে কান্ডারি বিধাতা, আশায় প্রার্থীরা

নির্বাচনী মহারণ সসম্মানে উতরোতে ‘উপরওয়ালা’ই মহাভরসা। দিন যত এগিয়ে আসছে, বড়-ছোট অখ্যাত-বিখ্যাত মন্দির-মসজিদে সপারিষদ প্রার্থীদের হত্যে দেওয়া বাড়ছে। এমনকী কট্টর ঈশ্বরবিরোধী বাম প্রার্থীরাও কখনও-সখনও ভগবানের বাড়ি ঢুকে পড়ছেন এবং পরে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন ‘পুজো নয়, ওটা নিছক জনসংযোগ।’

Advertisement

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:৩০
Share:

নির্বাচনী মহারণ সসম্মানে উতরোতে ‘উপরওয়ালা’ই মহাভরসা।

Advertisement

দিন যত এগিয়ে আসছে, বড়-ছোট অখ্যাত-বিখ্যাত মন্দির-মসজিদে সপারিষদ প্রার্থীদের হত্যে দেওয়া বাড়ছে। এমনকী কট্টর ঈশ্বরবিরোধী বাম প্রার্থীরাও কখনও-সখনও ভগবানের বাড়ি ঢুকে পড়ছেন এবং পরে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন ‘পুজো নয়, ওটা নিছক জনসংযোগ।’

ডানপন্থী ঈশ্বরমুখী প্রার্থীদের একাংশ আবার আধ্যাত্মিক বেগের পাশাপাশি খানিকটা সংস্কারাচ্ছন্নও হয়ে পড়েছেন। বেড়াল, হাঁচি, শালিক বা টিকটিকি-তত্ত্বের মতো ব্যাপ্যারস্যাপার সাময়িক ভাবে মানতে শুরু করেছেন। পি সি সরকারের মতো কেউ কেউ স্ত্রীর মুখ বা জলভরা পাত্র না দেখে প্রচারে বার হচ্ছেন না।

Advertisement

তৃণমূল প্রার্থী সৌগত রায় যেমন জানিয়েছেন, তিনি আদপেই ধার্মিক নন। কিন্তু ভোটের সময় পরিস্থিতি অনিশ্চিত থাকে বলে ধার্মিক হয়ে যান! তাই কিছু দিন আগেই খড়দহে শ্যামের মন্দিরে তৃণমূলের আর এক প্রার্থী দীনেশ ত্রিবেদীর সঙ্গে সন্ধ্যার হরিনামে জমিয়ে খোল-করতাল বাজিয়েছেন। তাতে নাকি মনে জোর এসেছে। কামারহাটিতে মাজার-এ চাদর চড়িয়েছেন, মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার আগে দক্ষিণেশ্বরের কালীমন্দিরে পুজোও দিয়েছেন। সোজাসাপ্টা বলেছেন, “ভোটের সময় মনটা একটু দুর্বল হয়ে যায়, তাই একটু ভগবান-ভগবান করি। তাই বলে আবার ভেবে বসবেন না যে, জয়ের ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই।”

শুনে ব্যঙ্গের হাসি হেসেছেন কংগ্রেস প্রার্থী আব্দুল মান্নান, “ধান্দাবাজ পাপী-রা শুধু বিপদে পড়লে ঈশ্বরকে ডাকে। আমাকে দেখুন, সারা বছর রক্ষাকালী পুজো, হনুমান পুজো সব করি আবার দিনে তিন বার নমাজ পড়ি, এক মাস রোজা রাখি। ঈশ্বর ওই ভণ্ডদের সাহায্য করবেন নাকি আমাদের মতো ভক্তদের দেখবেন?” প্রসঙ্গ উঠতে দীনেশ ত্রিবেদী আবার বৈদান্তিক দর্শনের কথা এনে ফেললেন। বললেন, “মানুষই ঈশ্বর। তার সেবাটাই আসল। পুজো একটা ধর্মীয় আচরণ মাত্র।

সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। অনেক প্রার্থীর কাছেই সেটা শো-বিজনেস। লোক-দেখিয়ে মন্দিরে গেল, কাগজে ছবি উঠল।” কিন্তু আপনি নিজেও তো মন্দিরে যাচ্ছেন, খোল-করতাল বাজাচ্ছেন। দীনেশের উত্তর, “সে তো দলের ছেলেদের আবদারে একটু করতে হয়।”

ভোটের সময় জনগণের আবদার ‘ফ্যাক্টর’ হয়ে দাঁড়াচ্ছে বলেই নাকি কিছু দিন আগে প্রচারে বেরিয়ে সিপিএম প্রার্থী রূপা বাগচীকে নিউ মার্কেটের কাছে এক মন্দিরে ঢুকতে হয়েছে! প্রবল নাস্তিক বলে পরিচিত রূপাদেবী খানিক অস্বস্তি নিয়ে বলেন, “মন্দিরে যাওয়া নিয়ে অযথা অপপ্রচার হচ্ছে। কিছু মহিলা আমার জন্য মালা নিয়ে মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন। সবাই ওখানে যেতে অনুরোধ করেছিলেন বলেই গিয়েছিলাম। এটা তো ভদ্রতা।” একই যুক্তি দিয়েছেন কাঁথির বাম প্রার্থী তাপস সিংহ। চৈত্র সংক্রান্তির পুজোয় ডিওয়াইএফের এই ডাকসাইটে নেতাকে দেখা গিয়েছিল। তা নিয়ে ফিসফাস শুরু হতে প্রার্থী জানিয়েছেন, চড়কের সন্ন্যাসী বা ভক্তা-রা তাঁর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে এসেছিলেন। জনসংযোগ ছাড়া এর মধ্যে আর কোনও পুজোটুজোর ব্যাপার ছিল না।

শোনা যাচ্ছে, ভোটের চাপে এক সময়ের নকশালপন্থী দোলা সেনও ঈশ্বরপন্থী হয়ে গিয়েছেন। অধুনা আসানসোলের তৃণমূল প্রার্থী ভোটে দাঁড়ানোর পর পাঁজি না দেখে এক পা-ও ফেলছেন না। দিনক্ষণমুহূর্ত দেখে মনোনয়ন পেশ করেছিলেন। আসানসোলের কল্যাণেশ্বরী মন্দির থেকে ঘাঘরবুড়ি মন্দির সব চষে ফেলেছেন। এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে উত্তর না দিয়ে ফোন রেখে দেন প্রার্থী।

মন্দির-মসজিদে ছুটে বেড়ানোর ব্যাপারে বিজেপি প্রার্থীদের সঙ্গে কিন্তু জোর টক্কর চলছে তৃণমূলের। চৈত্র সংক্রান্তির রাতে খোদ তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কালীঘাটের মন্দিরে গিয়ে পুজো দিয়ে এসেছেন বলে মন্দির সূত্রের খবর। তারাপীঠের মন্দিরে ইতিমধ্যেই পুজো দিয়েছেন শতাব্দী রায় এবং জয় বন্দ্যোপাধ্যায়। তারকেশ্বর মন্দিরে জল ঢেলেছেন সন্ধ্যা রায়, কাকলি ঘোষদস্তিদার, রত্না দে নাগ-রা। দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের অছি তথা সম্পাদক কুশল চৌধুরী জানিয়েছেন, বাপ্পি লাহিড়ী, সোমেন মিত্র, সৌগত রায়, তপন শিকদারেরা ঘুরে গিয়েছেন, আরও অনেকের আসার কথা। তাঁর কথায়, “শুধু প্রার্থীরা নন, ভোট-পর্যবেক্ষকেরাও কালীদর্শনে আসছেন। প্রত্যেককে ভিড় আর লাইন এড়িয়ে আলাদা করে মূর্তির সামনাসামনি নিয়ে গিয়ে দর্শন করিয়ে দিতে হচ্ছে।”

বাঁকুড়ার তৃণমূল প্রার্থী মুনমুন সেনও ঘুরছেন মন্দির-মসজিদে। রানিগঞ্জের একটি মাজার এবং মেজিয়ার কালীমন্দিরে গিয়েছিলেন প্রচারের একেবারে শুরুতে। কনভয় থামিয়ে অষ্টপ্রহর হরিনাম সংকীর্তনের আসরে নেমে পড়েছিলেন। পুজো দিয়েছেন ছিন্নমস্তার মন্দিরেও। তৃণমূলের আর এক অভিনেত্রী-প্রার্থী শতাব্দী রায়ের কথায়, “আমি ঠাকুর অন্ত প্রাণ। যেখানে যা মন্দির দেখি, প্রণাম করি। তারা মা ছাড়া কিছু ভাবতে পারি না। জীবনে যা পেয়েছি সব তারা মায়ের জন্য। এ বারেও ভোট ঘোষণার পর তারাপীঠ ঘুরে এসেছি।”


বিস্তারিত দেখতে ক্লিক করুন...

হাতের কর গুনে গুনে প্রবীণ বিজেপি প্রার্থী তপন শিকদার বললেন, “দক্ষিণেশ্বর, আদ্যাপীঠ, মহামিলন মঠ, হনুমান মন্দির, নিউ ব্যারাকপুরের বিশ্বমাতা মন্দিরে পুজো দিয়েছি। তারাপীঠটা যাব ভাবছি।” কিন্তু ঈশ্বরদর্শনে তো তাঁকে প্রায় হারিয়ে দিতে বসেছেন বিজেপিরই বাপ্পি লাহিড়ী। দক্ষিণেশ্বর, গণপতি মন্দির, হনুমান মন্দির সব ঘোরা হয়ে গিয়েছে তাঁর। গিয়েছেন গুরুদ্বারে। তারকেশ্বর যাবেন বলেও ভাবছেন। এমনিতে প্রতি শনি-মঙ্গলবার হনুমান মন্দিরে পুজো না দিলে তাঁর চলে না। ভোটের প্রচারের জন্য এক সপ্তাহ এই নিয়ম ভাঙতে হয়েছিল বলে মনমরা হয়ে ছিলেন। তার পর জেদ ধরে সময় বার করেছেন।

ভোটের সময়েই কেন ভক্তিবেগের এমন বাড়বাড়ন্ত? এ প্রসঙ্গে মনোবিদদের ব্যাখ্যা কিন্তু ভাবনার খোরাক জোগাচ্ছে। মনোবিদ নীলাঞ্জনা সান্যাল বলছেন, “সাফল্যের কামনা যখন প্রবল অথচ সেই প্রাপ্তি নিয়ে অনিশ্চয়তা এবং আত্মবিশ্বাসের যথেষ্ট অভাব, তখনই মানুষ বেশি-বেশি ভগবানের দ্বারস্থ হয়।” আর এক মনোবিদ রূপা তালুকদার মনে করেন, অনেক প্রার্থী নিজের ধর্মীয় ভাবমূর্তি তৈরি করতে বেশি করে ধর্মস্থানে যান। কারণ এখনও অনেক মানুষের ধারণা যে, ধার্মিকরা বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত হতেই পারেন না। সেই ধারণারই ফসল ঘরে তুলতে চান প্রার্থীরা।

‘বাবা তারকনাথ’ খ্যাত অভিনেত্রী প্রার্থী সন্ধ্যা রায় অবশ্য এই সব ব্যাখ্যা উড়িয়ে দিয়েছেন। নিজেকে ‘শিবভক্ত’ বলা এই প্রার্থী বিভিন্ন প্রচারসভায় তারকনাথের গান গেয়ে আঁচল পেতে ভোটভিক্ষা করছেন! বলেছেন, “ভোট বলে কেউ ইচ্ছা করলেই ঈশ্বরের থানে চলে যেতে পারেন না। বাবা না টানলে হয় না। ঈশ্বর অন্তর্যামী। জানেন, কে কত অসুবিধায় আছে। সেই মতো তিনি নিজের কাছে ডেকে আনেন।”

ভোলেবাবা শেষ পর্যন্ত ভোট-পারাবার পার করান কি না, দেখতে অপেক্ষা আর কিছু দিনের!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement