ভুল স্বীকার নিয়ে ভুল ভাবনা, মমতা রইলেন মমতাতেই

তিনি ভুল স্বীকার করলেন। এবং তিনি ভুল স্বীকার করলেন না! জল্পনার হাউই আকাশে উঠে গিয়েছিল। নিজেই নিভিয়ে দিলেন সব। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দেখিয়ে দিলেন, তিনি আছেন তাঁর নিজের অবতারেই। সিঙ্গুর থেকে সিন্ডিকেট কোনও কিছুই ‘ভুল’ বলে স্বীকার করার পাত্রী তিনি নন।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:৫০
Share:

বৃহস্পতিবার বিশ্ববঙ্গ সম্মেলনে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেব। ছবি: দেবাশিস রায়।

তিনি ভুল স্বীকার করলেন। এবং তিনি ভুল স্বীকার করলেন না! জল্পনার হাউই আকাশে উঠে গিয়েছিল। নিজেই নিভিয়ে দিলেন সব। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দেখিয়ে দিলেন, তিনি আছেন তাঁর নিজের অবতারেই। সিঙ্গুর থেকে সিন্ডিকেট কোনও কিছুই ‘ভুল’ বলে স্বীকার করার পাত্রী তিনি নন।

Advertisement

অথচ এর মিনিট কুড়ি আগেই একটা অদ্ভুত মুহূর্ত তৈরি হয়েছিল। অপার বিস্ময় ছড়িয়ে পড়েছিল হলের ভিতরে! বিস্ময়, কারণ সমাপ্তি ভাষণ দিতে দিতে মুখ্যমন্ত্রী অতীতের ঘটনার জন্য ক্ষমা চাইছিলেন! বিশ্ববঙ্গ সম্মেলনে উপস্থিত শিল্প-কর্তাদের অনুরোধ করছিলেন, তাঁরা যেন অতীতের স্মৃতি মনে না রাখেন!

উপস্থিত সিংহভাগের চোখে তখন নীরবে একটাই প্রশ্ন ঝিলিক দিচ্ছে! ঠিক শুনছি! কী বললেন উনি? কী বলতে চাইলেন? সত্যিই কি শিল্প মহলকে ইতিবাচক বার্তা দিতে চাইছেন?

Advertisement

বৃহস্পতিবার, শিল্প সম্মেলনের শেষ দিন তাঁর ভাষণের শেষের দিকে রাজ্যে লগ্নির সম্ভাবনা নিয়ে একগুচ্ছ ফিরিস্তি দেওয়ার পরে হঠাৎই অভ্যাগতদের কানে বেজে ওঠে, মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, “আপনারা আজ এবং আগামী দিনের দিকে চোখ রাখুন। অতীতে কী ঘটেছে দেখবেন না। অতীত চলে গিয়েছে। যা ঘটেছে, আমি তার জন্য ক্ষমা চাইছি।”

অতীত মানে? কোন অতীত? সিঙ্গুর? এবিজি? শ্যাম স্টিল? তোলাবাজি আর সিন্ডিকেট-রাজ?

ঘড়ির কাঁটা বিকেল তিনটের দিকে এগোচ্ছে। চর্চার আগুনে ফের ঘৃতাহুতি পড়ল ভাষণের একেবারে শেষে। শিল্প কর্তাদের ফের আসার আর্জি জানিয়ে মমতা বললেন, “আমাদের ভুলে যাবেন না। এবং আমাদের ভুল বুঝবেন না।”

কীসের ভুল? কার ভুল?

মুখ্যমন্ত্রী মাইকের সামনে থেকে সরতেই গুঞ্জনের বাঁধ ভাঙল। এত ক্ষণের যাবতীয় মুখ চাওয়াচাওয়ি এ বার ভাষা পেল।

গুনে রাখলে দেখা যেত, সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ ভাবছিলেন সিঙ্গুরের কথা। অনিচ্ছুক চাষিদের ৪০০ একর জমি ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে অনড় থাকা বিরোধী নেত্রী মমতার কথা। লাগাতার আন্দোলনের মুখে রাজ্য থেকে ন্যানো প্রকল্প গুটিয়ে নেন রতন টাটা। যাওয়ার আগে মমতাকে দুষে বলে যান, “বলেছিলাম, মাথায় বন্দুক ঠেকালেও আমি এখান থেকে যাব না। কিন্তু উনি (মমতা) তো ট্রিগারটাই টিপে দিলেন!’’

সিঙ্গুর আর নন্দীগ্রাম জমি আন্দোলনে ভর করেই রাজ্যে পরিবর্তন এনেছিলেন মমতা। সঙ্গে অর্জন করেছিলেন শিল্প-বিরোধী তকমাও। সেই তকমা ঝেড়ে ফেলার কথা মুখে বললেও কাজে তার প্রতিফলন ঘটে না, এমনটাই অভিযোগ শিল্প মহলের। জমির প্রশ্নে মমতা আজও একই রকম অনড়। সেই মমতা শিল্প সম্মেলনের মঞ্চে সিঙ্গুরের জঙ্গি আন্দোলনের জন্য ক্ষমা চাইলে, রাজ্যে শিল্প-ভবিষ্যৎ অন্য রকম হতে পারত। মমতা সেই ‘ঐতিহাসিক ভুল’ স্বীকার করেননি!

শুধু সিঙ্গুর কেন, এবিজি- তোলাবাজি-সিন্ডিকেট কোনওটার জন্যই আসলে ক্ষমা চাননি তিনি। একটু পরে নিজে বলেও দিলেন সেটা। তার আগে কেউ কেউ যুক্তি সাজাচ্ছিলেন, ‘‘তোলাবাজি-সিন্ডিকেট অতীত হল কীসে? এ তো জ্বলন্ত বর্তমান!’’ কারও গলা ছিল আশাবাদী, “মুখ্যমন্ত্রী বোধহয় বলতে চাইছেন, তোলাবাজি-সিন্ডিকেটের যুগ অতীত হয়ে যাবে!’’

কিন্তু না। মমতা দ্রুত বুঝিয়ে দিলেন, ভুলের ব্যাখ্যা নিয়ে ভাবাটাই ভুল। কারণ তিনি দাবি করলেন, তিনি নাকি বাম আমলের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন! এর সঙ্গে সিঙ্গুর ইত্যাদির কোনও সম্পর্কই নেই।

‘প্রোটোকল লাউঞ্জ’ থেকে বেরিয়ে গাড়িতে ওঠার আগে ফোন নিয়ে একটু দূরে সরে গিয়েছিলেন মমতা। ফিরে আসার সময়েই সংবাদমাধ্যম তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চায়। তখনই প্রশ্ন করা হয়, তিনি কোন ভুলের জন্য ক্ষমা চাইলেন?

মমতা জল্পনার সমস্ত ফানুস চুপসে দিয়ে জবাব দেন, তিনি আগের সরকারের বিপুল ধারের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন শিল্পমহলের কাছে। তাঁর বক্তব্য, বাম আমলে রাজ্যে আর্থিক ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা ছিল। রাজস্ব আদায়ের কোনও পরিকল্পনা ছিল না। সেই আর্থিক বোঝার ফল ভুগতে হচ্ছে তাঁদের। এ সবের জন্যই তিনি ক্ষমা চেয়েছেন।

ব্যাখ্যা শেষ। মমতা এ বার ‘মিডিয়া লাউঞ্জ’-এ। সঙ্গে রাজ্যসভার সাংসদ ডেরেক ও’ব্রায়েন। তাঁর ক্ষমা চাওয়ার সঙ্গে সিঙ্গুর প্রসঙ্গের কথা যে হাওয়ায় ভাসছে, সেটা কোনও ভাবে হয়তো কানে গিয়েছিল তাঁর । ফলে ক্ষোভ উগরে দিয়ে মমতা সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলে উঠলেন, “সিঙ্গুরের কথা কেন আপনাদের মাথায় এল? কী ভাবে এল?”

সাংবাদিকরা বললেন, ভুল ধারণা যাতে তৈরি না হয়, তার জন্যই তাঁরা সরাসরি প্রশ্ন করে জেনে নিচ্ছেন। মুখ্যমন্ত্রী জবাব দিলেন, তিনি ‘টাফ লোক’। সিঙ্গুর নিয়ে কোনও রকম আপস করবেন না।

অতএব? মমতার ‘ভুল’ স্বীকার, তাই নিয়ে ‘ভুল’ ভাবনা এবং মমতার নিজেরই সেই ‘ভুল’ শুধরে দেওয়া এ ভাবেই বৃত্তটা সম্পূর্ণ হল বৃহস্পতিবার।

বিরোধী শিবির অবশ্য দাবি করছে, এমনটাই হওয়ার ছিল। রাজ্য বিজেপি সভাপতি রাহুল সিংহ বলছেন, “মমতা সত্যিই নিজের ভুল স্বীকার করলে সূর্য পশ্চিম দিকে উঠত!” শিল্প মহলেরও বড় অংশের বক্তব্য, শিল্প-নীতিতে বড় ধরনের কোনও পরিবর্তনের ইঙ্গিত তো শিল্প সম্মেলনে উঠে আসেনি। তা হলে শেষ দিনে মমতা কোন ভুলই বা স্বীকার করতে পারতেন? ভুল মানতে হলে তো তাঁকে জমি নীতি বদলাতে হবে! এসইএজেড নিয়ে নীতি বদলাতে হবে! তোলাবাজি-সিন্ডিকেট রুখতে হবে! সে সব প্রতিশ্রুতি মমতা কিন্তু দেননি।

বরং শিল্প সম্মেলনের প্রথম দিনেই মুখ্যমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছিলেন জমি অধিগ্রহণের বিরোধিতা থেকে তাঁর অবস্থানের একটুও বদল ঘটেনি। এ দিনও ফের বললেন, “সকলে বলে জোর করে জমি অধিগ্রহণ (যদিও শিল্পমহল কোনও দিনই জোর করে অধিগ্রহণের কথা বলেনি) না করলে শিল্প হবে না। এটা ভুল। (আপনারা) আলোচনার পথে যান।” তাঁর একই দাবি, রাজ্যে জমির সমস্যা নেই। যদিও শিল্পমহলের প্রশ্নও সেই একই, আলোচনা করে এক লপ্তে বড় জমি যেখানে পাওয়াই দুষ্কর, সেখানে আলোচনার পথে হেঁটে লাভ কী?

চটজলদি সমাধান সূত্র হিসেবে মমতা বরাবরই একাধিক কমিটি গড়ার কথা বলেন। এ দিনও বলেছেন, এই শিল্প সম্মেলনে লগ্নির প্রস্তাব কতটা কার্যকরী হল তা খতিয়ে দেখতে একটি কোর-গ্রুপ গড়া হবে। তাঁর দাবি, এ বারের সম্মেলন একটা ‘মার্ভেলাস অ্যাচিভমেন্ট’। জানানো হয়েছে, এ দিন থেকেই তৈরি হবে এই সম্মেলনের খুঁটিনাটি নিয়ে একটি প্রশাসনিক ক্যালেন্ডার। আগামী বছর এই সম্মেলন হবে ৮-৯ জানুয়ারি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন