মেধাবী সুমন্তিকা ছিলেন পাহাড়িপাড়ার ‘আইকন’

পাড়ার গৌরব ছিল মেয়েটি। তাকে দেখিয়ে অন্যদের বলা হত, রিয়ার মতো হওয়ার চেষ্টা করো। সুমন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায় (২২) তথা রিয়ার দেহ উদ্ধারের পরে তাই জলপাইগুড়ির শোকস্তব্ধ পাহাড়ি পাড়া হারিয়েছে তার নিজস্ব ‘আইকন’কে। রবিবার সকালে কলকাতা যে বাড়িতে সে পেয়িং গেস্ট থাকত, সেখান থেকে রিয়ার দেহ উদ্ধার হয়।

Advertisement

বিশ্বজ্যোতি ভট্টাচার্য

জলপাইগুড়ি শেষ আপডেট: ০৫ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:২০
Share:

জলপাইগুড়ির পাহাড়িপাড়ায় সুমন্তিকাদের বাড়ির সামনে ভিড়।

পাড়ার গৌরব ছিল মেয়েটি। তাকে দেখিয়ে অন্যদের বলা হত, রিয়ার মতো হওয়ার চেষ্টা করো। সুমন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায় (২২) তথা রিয়ার দেহ উদ্ধারের পরে তাই জলপাইগুড়ির শোকস্তব্ধ পাহাড়ি পাড়া হারিয়েছে তার নিজস্ব ‘আইকন’কে।

Advertisement

রবিবার সকালে কলকাতা যে বাড়িতে সে পেয়িং গেস্ট থাকত, সেখান থেকে রিয়ার দেহ উদ্ধার হয়। জলপাইগুড়িতে তার পাড়ার পুরনো বাসিন্দা সোমনাথ সরখেল, সরু গলির বাঁকে দাঁড়িয়ে চোখ মুছলেন বার কয়েক। সামনে রিয়াদের বাড়ি। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, “পাড়ার অহঙ্কার ছিল রিয়া। ওকে ঘিরে কত স্বপ্ন দেখেছি আমরা। কয়েক বছরের মধ্যে মেয়েটি গবেষণা করে ভাবনায় মৌলিকত্বের প্রমাণ দেবে প্রত্যাশা ছিল। হল না।”

প্রেসিডেন্সির সুমন্তিকা পাহাড়িপাড়ার অলিগলিতে রিয়া নামে বেশি পরিচিত। শহরের নামী বেসরকারি স্কুলে পড়ার সময় থেকে ধারাবাহিক সাফল্য দেখে একটু একটু করে গোটা পাড়ার লোকজন কোন সময় আদরের রিয়াকে ‘আইকন’ ভাবতে শুরু করেছিল নিজেরাও জানেন না। গৃহবধূ শিপ্রা দাসের কথায়, “পাড়ায় খুদেরা দুষ্টুমি করলে সগর্বে বলতেন---রিয়া দিদির মতো হও। বায়না ধরলে বলা হত, রিয়াদিদির মতো হও, সব পাবে।” কথা শুনে মাথা নেড়ে সায় দেন সোমনাথবাবু। তিনি জানান, “পাড়ার অভিভাবকদের প্রত্যাশা তাঁদের ছেলেমেয়েরা যেন রিয়াকে দেখে বড় হয়। তাই ওর কথা গল্প করে বলে।”

Advertisement

রবিবার সকাল সাড়ে ন’টা নাগাদ মোবাইল ফোনে পাহাড়িপাড়ার বাড়িতে খবর পৌঁছয় রিয়া নেই। এর পর থেকে গোটা পাড়া স্তম্ভিত। শহর ভেঙে পরে বাড়িতে। সত্যি কি রিয়া নেই? জানতে ভিড় বাড়ে সোমনাথবাবুর মতো অনেকে আড়ালে কান্নায় ভেঙে পড়েন। আবার প্রবীণ বাসিন্দা মানস সরকারের মতো অনেকের ঘটনাটি বিশ্বাস করতে মন সায় দেয়নি। মানসবাবু বলেন, “আমাদের কোলে মেয়েটি বড় হল। এত মেধাবী হয়েও কত সম্মান দিয়ে কথা বলত। ১ জানুয়ারি দেখা হল। বলল, হ্যাপি নিউ ইয়ার জ্যাঠু। আমাদের রিয়া এ ভাবে চলে যাবে, কিছুতে মানতে পারছি না।”


জলপাইগুড়ির পাহাড়িপাড়ার বাড়িতে সুমন্তিকার শোকস্তব্ধ পরিজনেরা।

রিয়ার দোতলা বাড়ির উল্টো দিকে থাকেন তৃণমূলের প্রদেশ সম্পাদক কল্যাণ চক্রবর্তী। সকালে খবর পেয়ে তিনি এ দিন পাড়ার বাইরে পা রাখেননি। যদিও রিয়ার বাবা পেশায় বিমাকর্মী দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়কে সান্ত্বনা জানানোর ভাষা খুঁজতে ওই ঝানু রাজনীতিককেও ঘাম ঝরাতে হয়েছে। কল্যাণবাবু বলেন, “শুধু পাহাড়িপাড়া নয়, গোটা জলপাইগুড়ি শহর বিরাট সম্পদ হারাল। জেলা হারাল সম্ভাবনা। ব্যাতিক্রমী মেয়ে ছিল রিয়া। ওকে নিয়ে কত আশা প্রত্যাশা। সব শেষ হয়ে গেল।” ব্যাতিক্রমী ছাত্রীর টানে খবর পেয়ে এদিন সকালে বাড়িতে ছুটে যান রিয়ার শৈশব থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল সিস্টার ক্রিস্টিন। কী বলে প্রিয় ছাত্রীর পরিবারের লোকজনকে সান্ত্বনা জানাবেন, ভাষা খুঁজে পাননি। তাঁর মুখেও ছিল একই কথা, এই মেয়ে ছিলেন ব্যাতিক্রমী।

পাড়ার লোকজন জানান, রিয়া ছিলেন নম্র, ভদ্র। মিশুকে। প্রতি বছর পুজোয় বাড়িতে আসতেন। সময় কাটত পাড়ার মণ্ডপে। গত পুজোতেও হইচই করেছেন। খবর পেয়ে বান্ধবীদের অনেকে এ দিন রিয়াদের বাড়িতে ছুটে যান। তাঁদের কয়েকজন জানান, গত পুজোতে চুটিয়ে মজা করেছেন তাঁরা। গত ২৪ ডিসেম্বর বড় দিনের ছুটিতে এসে দেখা করেছেন। রিয়ার মৃত্যুর খবর পেয়ে তাঁরাও অবাক। তাঁদের একজন বলেন, “রিয়া বেশ কিছুদিন কলকাতায় চলে গিয়েছে। কিন্তু আমরা তো ওকে চিনি। ওর গোটা জীবনের সঙ্গে এই ঘটনার কোনও মিল নেই। ভাল করে তদন্ত করে দেখা উচিত, ঠিক কী ঘটেছিল।”

ছবি: সন্দীপ পাল

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন