বৈষ্ণব পরিবারের শিশুটির অঙ্গনওয়াড়িতে খাওয়া নিষেধ। সেখানে পেঁয়াজ-রসুন দিয়ে রান্না হয় যে। দক্ষিণ দিনাজপুরের নন্দনপুর গ্রামের খুদে পড়ুয়াটির বন্ধুদের সঙ্গে পাত পেড়ে বসে খাওয়া হয় না। তাই মামার বাড়ি গেলেই ছুট লাগায় সেখানকার অঙ্গনওয়াড়িতে। দিব্যি চেটেপুটে খায় খিচুড়ি, তরকারি, আধখানা ডিম।
জলপাইগুড়ির নেপালি লাইনে হাতির হানার ভয়ে কাঠের খুঁটির উপরে তৈরি হয় বাড়ি। তেমনই এক বাড়ির নীচে ঠাঁই হয়েছে এলাকার অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের। শিশুরা সেখানে ঢুকতে পারলেও, দিদিমনির খাড়া হয়ে দাঁড়ানো অসম্ভব। সেই অবস্থাতেই তিনি এ-বি-সি-ডি, ওয়ান-টু-থ্রি শেখাচ্ছেন পড়ুয়াদের। বইও জোগাড় করেছেন নিজেই। দেখা গেল, পড়ুয়ারাও ইংরেজিতে অল্প কিছু কথা বলতে পারছে।
সরকারি প্রকল্পের বিচার হয় ব্যর্থতা দিয়ে। কী লক্ষ্য ছিল, কতটুকু হল, তার হিসেব কষাই দস্তুর। কিন্তু তাতে প্রকল্পের সঙ্গে জড়িয়ে-থাকা জীবনের গল্পগুলো বাদ পড়ে যায়। প্রতীচীর দ্বিতীয় ‘চাইল্ড রিপোর্ট’ ওই বাড়তি মাত্রাকে ধরতে চেয়েছে। তাই তথ্য-পরিসংখ্যানের পাশাপাশি সমীক্ষকের চোখে-দেখা দৃশ্য, কানে-শোনা কথাও আছে রিপোর্টে। আজ, সোমবার, পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারে অঙ্গনওয়াড়ি প্রকল্পের উপর প্রতীচীর রিপোর্ট উদ্বোধন করবেন অমর্ত্য সেন।
প্রাক-কথনে অমর্ত্য সেন লিখছেন-- বিশ্বের সর্বত্রই ক্রমশ এই বোধ বাড়ছে যে, শিশুদের পুষ্টি, স্বাস্থ্য, শিক্ষার নিরিখে দেশের সাফল্যের বিচার করা দরকার। অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলির পরিষেবায় যে অনেক ফাঁক থেকে যাচ্ছে, তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তিনি। তবে কেন্দ্রের সংখ্যা যে অনেক বেড়েছে, তাকেও গুরুত্ব দিয়েছেন।
২০০৮ সালে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র নিয়ে প্রথম রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল প্রতীচী। এ বার একই কাজ করতে গিয়ে কী পরিবর্তন চোখে পড়ল? এক গবেষকের অনুভব, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র এর মধ্যে বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। কেন্দ্রগুলির কাজের ভালমন্দ তুলনা করতে পারছেন বাসিন্দারা। তাই তাঁদের চাহিদার চাপ বাড়ছে। ফলে খাবার সরবরাহ, আর খাবারের মান, দুয়েরই আগের চাইতে উন্নতি হয়েছে। অধিকাংশ মা বলেছেন, খাবারের মান ও পরিমাণে তাঁরা সন্তুষ্ট। কেন্দ্রে পড়াশোনা হয় না, মায়েদের সেই নালিশও এ বার অনেক কমেছে।
তবু কেন্দ্রগুলিতে গিয়ে না দাঁড়ালে বোঝা যায় না, ফাঁক কোথায়, ফাঁক কত বড়। বর্ধমানের মন্তেশ্বরের একটি গ্রাম জয়রামপুর। সেখানে ছোটদাসপাড়ার কেন্দ্রটি বড় রাস্তার পাশে। দু’পাশে দুটো বড় পুকুর, কেন্দ্রের ভবনের গা ঘেঁষে বিদ্যুৎ ট্রান্সফর্মার। কতটা অরক্ষিত এই কেন্দ্রের খুদে পড়ুয়ারা, তা কি বোঝা যেত কেবল পাঁচিলহীন স্কুলের সংখ্যা থেকে? শিশুর নিরাপত্তার অধিকারও শিক্ষার অধিকারের মধ্যে পড়ে, চিন্তাটা উস্কে দিচ্ছে প্রতীচী রিপোর্ট।