ওঁরা আছেন মাঝখানে।
ঘর আর পারের নয়, জ্বলন্ত উনুন আর তেতে থাকা তাওয়ার।
সামনে এগোলে পিরপুর পাড়া, ফাঁসির আসামি পাঁচ জন। পিছু হটলে নাথপুর, ফাঁসির আসামি চার, যার মধ্যে একটি নাম লঙ্কেশ্বর ঘোষ ওরফে লঙ্কা। দুইয়ের মাঝে ঘুঘড়াগাছি।
অপর্ণা বাগ হত্যাকাণ্ডে ১১ জনের ফাঁসির সাজা হয়েছে বৃহস্পতিবার। কিন্তু তার পরেও নদিয়ার ঘুঘড়াগাছি গ্রাম যেন সিঁটিয়ে রয়েছে।
শুক্রবার তখনও দুপুর গড়ায়নি। কিন্তু গ্রাম প্রায় নিঝুম। পুলিশের গাড়ি টহল দিচ্ছে। খানিক তফাতে হাত ধরে ফিরছে স্কুলের খুদেরা। কারবারিদের মালপত্র নিয়ে ছোট গাড়ি ছুটছে।
কিন্তু গ্রামের মধ্যে একটু ঢুকলেই গা ছমছম করবে। সুনসান মেঠো পথের ধারে শুকোচ্ছে শাড়ি-জামা। বাঁশঝাড়ের মধ্য দিয়ে খড়ের আঁটি নিয়ে আসছে গরুর গাড়ি। বাড়ির বাগান থেকে উঁকি দিয়েই লুকিয়ে গেল ঘোমটা ঢাকা একটি মুখ।
বাড়ির উঠোনে বাবা দেবানন্দের সঙ্গে শুকনো পাতা জড়ো করছিল দেবিকা, অপর্ণা বাগের ছোট মেয়ে। সাড়া পেয়ে বেরিয়ে আসে বড় মেয়ে নীলিমাও। ‘‘ভ্যানে মাল নিয়ে বাবাকে নানা জায়গায় যেতে হয়। নাথপুরের উপর দিয়ে হোক বা পিরপুর পাড়া দিয়ে। আমরা বাবার জন্য খুব ভয়ে থাকি’’ —নিচু গলায় বলেন নীলিমা।
নীলিমার ভাই, বছর কুড়ির দীপঙ্কর অভাবের কারণে বাড়ির পাশে ইটভাটায় কাজ নিয়েছে। সে-ও বলে, ‘‘ট্রাক্টরে ইট নিয়ে ভাটা থেকে নানা জায়গায় দিয়ে আসতে হয়। তখন যদি কেউ ধরে? দিন কয়েক আগেও কৃষ্ণগঞ্জ গিয়েছিলাম। রায় বেরোনোর পরে আর সাহস পাচ্ছি না।’’
কৃষ্ণগঞ্জ ব্লক সদর। নানা রকম দরকারে সেখানে যাতায়াত করতেই হয়। কৃষ্ণগঞ্জ থেকে যে রাস্তা সোজা খালবোয়ালিয়া বাজারে চলে গিয়েছে, তার উপরেই পিরপুর পাড়া। এর পরে স্বর্ণখালি হয়ে ঘুঘড়াগাছি। ওই গ্রাম ছাড়িয়ে খানিক এগোলে নাথপুর। খেতের ফসল কৃষ্ণগঞ্জ হয়ে মাজদিয়া বাজারে নিয়ে যেতে গেলেও এলাকার মানুষকে ওই রাস্তাই ধরতে হয়। তার মাসুলও দিতে হয়েছে। মামলা চলার সময়েই সব্জি হাটে নিয়ে যেতে বাধা দেওয়া হয়েছে। মারধরও করা হয়েছে।
আতঙ্ক অতএব আশ্চর্যের নয়। এ দিন গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির সদস্যারা গ্রামে গেলেও ভয় কমেনি। ঘটনার পরেই যিনি প্রতিবাদে ফেটে পড়েছিলেন, দোষীদের কঠিন সাজা দাবি করেছিলেন, তিনি রায় শোনার পরে একটি বারও অপর্ণার বাড়িমুখো হননি। ইতিমধ্যে আদালতে বয়ান বদলে তিনি ‘বিরূপ সাক্ষী’ হয়েছেন। এখন দৈবাৎ দেবানন্দের মুখোমুখি পড়ে গেলে চোখ সরিয়ে নিয়ে সরে পড়ছেন। কেন দাদা? চারদিক ভাল করে দেখে নিয়ে মানুষটি বললেন, ‘‘লঙ্কারা নয় জেলে। ওদের আরো লোকজন আছে চারপাশে। তারা কি ছেড়ে কথা বলবে?’’
এই আশঙ্কাই তাড়া করে বেড়াচ্ছে গোটা গ্রামকে। কেন, পুলিশ আছে তো? প্রায় ফিসফিস করে গ্রামের এক বৃদ্ধ বলেন, ‘‘ভয় পাব না? আমরা যে আছি মাঝখানে। দু’দিক দিয়ে পিষে মারবে।’’ গ্রামে এখনও পুলিশ টহল দিচ্ছে। কিন্তু তাতে কী? বৃদ্ধ বলেন, ‘‘পুলিশ তো দু’দিন! স্ত্রী-সন্তান নিয়ে লোকে কি মরবে? কে সামলাবে?’’ স্থানীয় জয়ঘাটা পঞ্চায়েতর সিপিএম সদস্য প্রবীর বিশ্বাস বলেন, ‘‘লঙ্কা-বাহিনীর লক্ষ লক্ষ টাকার লেনদেন বন্ধ হয়ে গিয়েছে এই ঘটনায়। তারা কি সহজে সব হজম করে নেবে?’’