ম্যাজিক তুমি কার, সবই মায়া

প্রচারের জন্য হাতে সময় সাত দিনেরও কম। তবু সারাদিন তাঁর কোনও নির্বাচনী কর্মসূচি নেই! পরম নিশ্চিন্তে বাড়িতে সারাদিন তিনি মোটামুটি বিশ্রামে। প্রার্থীদের ছকে বাঁধা ডায়েরির সঙ্গে এটা কেমন যেন বেমানান। পরীক্ষার সাত দিন আগে গা-ছাড়া ভাব দেখাতে পারে কোন ছাত্র? যে তার সাফল্য নিয়ে ষোলো আনা নিঃসংশয়, অথবা যে জানে কোনও অবস্থাতেই তার উতরে আসার সুযোগ নেই।

Advertisement

দেবাশিস ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০১৪ ০৩:২০
Share:

প্রচারের জন্য হাতে সময় সাত দিনেরও কম। তবু সারাদিন তাঁর কোনও নির্বাচনী কর্মসূচি নেই! পরম নিশ্চিন্তে বাড়িতে সারাদিন তিনি মোটামুটি বিশ্রামে। প্রার্থীদের ছকে বাঁধা ডায়েরির সঙ্গে এটা কেমন যেন বেমানান।

Advertisement

পরীক্ষার সাত দিন আগে গা-ছাড়া ভাব দেখাতে পারে কোন ছাত্র? যে তার সাফল্য নিয়ে ষোলো আনা নিঃসংশয়, অথবা যে জানে কোনও অবস্থাতেই তার উতরে আসার সুযোগ নেই।

প্রদীপচন্দ্র কোন গোত্রের?

Advertisement

বারাসতের বিজেপি প্রার্থী পি সি সরকার (জুনিয়র) ফুঁসে উঠলেন: “ছাত্র হতে যাব কেন? আমি শিক্ষক। আমাকে দিনরাত বই মুখে বসে থাকতে হয় না। আমি অন্যদের ‘এটা কর, ওটা কর’ বলে নির্দেশ দিই। তাতেই কাজ হয়ে যাচ্ছে।”

দক্ষিণ কলকাতায় ইএম বাইপাস লাগোয়া বাড়ি। জাদুকর প্রদীপচন্দ্রের নিজস্ব কাজের ঘরে বেশ একটা ‘পদ্ম-পদ্ম’ ভাব। দেওয়ালের কোণায় দলের ঝান্ডা, টেবিলে জড়ো করে রাখা বিজেপি-র নানারকম বই, পুস্তিকা, প্রচারপত্র, প্রার্থী-পরিচিতির লিফলেট। খবরের কাগজ থেকে দরকারি খবর কেটে আলাদা ক্লিপিং তৈরি করা হচ্ছে নিয়মিত। ‘স্ট্রিক্টলি কনফিডেন্সিয়াল’ মার্কা দেওয়া ফাইলে মুড়ে তাঁর কাছে চলে আসছে নির্বাচনী খরচের দৈনন্দিন হিসেবপত্তর। কে বলবে, রাজনীতিতে এটাই তাঁর হাতেখড়ি!

পরিচিতিপত্রে প্রদীপচন্দ্র নিজেও লিখেছেন: ‘আমি রাজনীতির লোক নই। কিন্তু অন্যান্য মহাপুরুষের সঙ্গে রাজনৈতিক বড় বড় ব্যক্তিদেরও আমি মায়াজালে আবদ্ধ করতে ওস্তাদ।’ তাঁর দাবি, ‘নিজের জানা সব ম্যাজিক খাটিয়ে’ তিনি সব খারাপ জিনিস ‘ভ্যানিশ’ করে দেবেন। সংসদীয় রাজনীতিতে মায়াজাল বিস্তারের এমন ‘ওস্তাদি’ কোনও নতুন ধারা তৈরি করবে কি না, তার জবাব দেবে ভবিষ্যৎ। তবে আপাতত বিজেপি-র মায়ায় বারাসতের নির্বাচনী আবহ কিছুটা হলেও আচ্ছন্ন, সন্দেহ নেই।

তৃণমূল প্রার্থী কাকলি ঘোষদস্তিদার গত বার জিতেছেন লক্ষাধিক ভোটে। তকমায় ডাক্তার হলেও রাজনীতিতে তিনি অনেক দিনের পুরনো মুখ। নিজের কেন্দ্রে অনাবাসী নন। প্রচুর কাজও করেছেন। সর্বোপরি গত বিধানসভা নির্বাচনে তাঁর এই কেন্দ্রে তৃণমূল একচ্ছত্র আধিপত্যে বলীয়ান।

সে দিক থেকে পি সি সরকার একেবারেই আনকোরা। কোনও দিন প্রত্যক্ষ রাজনীতির উঠোনে পা-ও রাখেননি। নিজেই বলেছেন, ব্রিগেডে মোদীর সভায় তিনি গিয়েছিলেন স্রেফ আমন্ত্রিত শ্রোতা হিসাবে। আচমকা তাঁকে মঞ্চে জায়গা দেওয়া হয়। তার পরে দলের রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ বাড়িতে এসে তাঁকে ভোটে দাঁড়াতে রাজি করান। তাঁর কথায়, “আমাকে অনেকেই এর আগে রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার কথা বলেছিল। এমনকী, সরাসরি রাজ্যসভায় যাওয়ার প্রস্তাবও এসেছে। নিইনি। এ বার নিয়ে ফেললাম।”

কিন্তু হাওয়া ব্যক্তিনির্ভর হয় না। প্রার্থীর নাম-পরিচয় সেখানে কার্যত নগণ্য হয়ে যায়। তাই সদ্য রাজনীতির জামা গায়ে চড়ানো পি সি সরকার তাঁর যাবতীয় রাজনৈতিক অনভিজ্ঞতা এবং অপটুতা সত্ত্বেও বারাসতের লড়াইতে বড় চ্যালেঞ্জার হয়ে উঠতে পেরেছেন। অথচ সাংগঠনিক শক্তিতে বিজেপি এখানে এখনও বেশ দুর্বল। তৃণমূলের চেয়ে তো বটেই, ক্ষয়িষ্ণু বামেদের তুলনায়ও এরা দৃশ্যত কমজোরি। তবু কাকলির মতো পোড় খাওয়া নেত্রীকে উদয়াস্ত খাটতে হচ্ছে। একাধিক সভা করে গিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

বারাসত কেন্দ্র অতীতের পূর্ব পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ থেকে আসা শরণার্থীদের বড় ঘাঁটি। যাঁরা এক সময় ও পার থেকে শরণার্থী হয়ে এসেছিলেন, তাঁরা এখন বিভিন্ন কলোনির স্থায়ী বাসিন্দা। এলাকায় ঘুরলে সেই কলোনি-ভোটারদের মধ্যে একটা অন্যতর স্পন্দন টের পাওয়া যায়। হয়তো তাই চতুর কৌশলে বিজেপি প্রার্থী নিজেকে বলেছেন, ‘ছিন্নমূল রিফিউজি পরিবারের সন্তান’। এতে কতটা কী ফল মিলবে, বলা শক্ত। কিন্তু বারাসত স্টেশনের গায়ে শম্ভু ব্রহ্মের মিষ্টির দোকানের সামনের আড্ডায় যাঁরা নাম বলতে অনিচ্ছুক, তাঁরাও মনের কথাটা খোলসা করে বলতে নারাজ। রাজনীতির রুল বুকে এই নীরবতাটা অর্থবহ! চুপচাপ কোথায় ছাপ?

রাজনীতির সহজ ব্যাকরণ মেনে কাকলি আস্থা রাখেন তাঁর কাজে। তিনি বিশ্বাস করেন, সাংসদ তহবিলের সব টাকা উজাড় করে খরচ করার সুফল পাওয়া সম্ভব। বস্তুত দেশের যে সব কেন্দ্র সাংসদ তহবিলে টাকা খরচের শীর্ষে, বারাসত তার একটি। তহবিলের টাকা ছাড়াও বাড়তি টাকায় আরও বেশ কিছু কাজ তিনি করেছেন। কিন্তু কোনও জনসমষ্টি যদি সামগ্রিক ভাবে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার পথে যায়, উন্নয়নের বাঁধ দিয়ে তা কতটা রোখা যাবে, বলা কঠিন। তৃণমূলের হিসেবের অঙ্কে অবশ্য ৪০ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোটও আছে। তবে তার ভাগীদার হতে ওৎ পেতে আছে ফরওয়ার্ড ব্লক এবং কংগ্রেস। বিনা যুদ্ধে তারাই বা ভূমি ছাড়বে কেন!

ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত পদযাত্রার পরে সামান্য বিরতিতে বারাসতের বাড়িতে পাওয়া গেল কাকলিকে। কথাবার্তার মধ্যেই ফোনে চলছে শেষ বেলার ফাঁকফোকর ভরানো দেগঙ্গায় আরও একটু জোর দিতে হবে, কোথায় আরও একবার যাওয়া উচিত, কোথায় এখনও যাওয়া হয়নি, সেই সব হিসেবনিকেশ। কাকলি মানতে না চাইলেও লোকে বলে, তৃণমূলের একাংশ নাকি তাঁর সঙ্গে পূর্ণ সহযোগিতায় নারাজ। আর তা নস্যাৎ করতে কাকলি ঘোষদস্তিদারের দাবি, “এ বার আমার জয়ের ব্যবধান গত বারের চেয়েও বাড়বে।”

রাজনীতিতে ‘ম্যাজিক’ কথাটা কখনও প্রশংসার, কখনও তাচ্ছিল্যের। মমতা-ম্যাজিক, মোদী-ম্যাজিক বলতে তারিফ বোঝায়। আবার ম্যাজিক করে সমস্যার সমাধান হবে না বললে ম্যাজিকের অবাস্তবতা সামনে আসে। পি সি সরকার বলেন, “ম্যাজিক তো মায়া। সাধারণ ভাবে যা ঘটে না, ঘটতে পারে না, সেটা ঘটানোই তো মায়াজাল।”

কিন্তু রাজনীতির শক্ত জমিতে ‘মায়া’ দিয়ে ‘মমতা’র মোকাবিলা! তা-ও কি সম্ভব? জাদুকরের জলদি জবাব: “আমার লড়াই কোনও দল বা ব্যক্তির সঙ্গে নয়। ম্যাজিশিয়ান কখনও স্টেজে উঠে ফ্লপ করে না।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন