মালদহে এখনও গনি বনাম গনি

তাঁর মৃত্যুর পরে কেটে গিয়েছে আট বছর। মহানন্দা দিয়ে বয়ে গিয়েছে অনেক জল। কিন্তু মালদহে ভোটের গীতে এখনও গনি খানই কানু! আবু বরকত আতাউর গনি খান চৌধুরীর অশরীরী উপস্থিতি মালদহের ভোট-রাজনীতিতে আজও উজ্জ্বল। সারা দেশ জুড়ে ‘মোদী-হাওয়া’ বইলেও মালদহে ‘গনি-বাতাস’ দিব্যি টের পাওয়া যায়! পক্ষ-প্রতিপক্ষের প্রচারে বারবার ফিরে ফিরে আসে গনির কথাই।

Advertisement

সঞ্জয় সিংহ

মালদহ শেষ আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:০১
Share:

তাঁর মৃত্যুর পরে কেটে গিয়েছে আট বছর। মহানন্দা দিয়ে বয়ে গিয়েছে অনেক জল। কিন্তু মালদহে ভোটের গীতে এখনও গনি খানই কানু!

Advertisement

আবু বরকত আতাউর গনি খান চৌধুরীর অশরীরী উপস্থিতি মালদহের ভোট-রাজনীতিতে আজও উজ্জ্বল। সারা দেশ জুড়ে ‘মোদী-হাওয়া’ বইলেও মালদহে ‘গনি-বাতাস’ দিব্যি টের পাওয়া যায়! পক্ষ-প্রতিপক্ষের প্রচারে বারবার ফিরে ফিরে আসে গনির কথাই। প্রয়াত এই কংগ্রেস নেতার দলের প্রার্থীরা স্বাভাবিক ভাবেই ‘গনি মিথ’ আঁকড়ে ধরে উন্নয়নের স্বপ্ন ফেরি করছেন। কিন্তু রাজ্যের শাসক দল তৃণমূলেরও লক্ষ্য গনি-উত্তরাধিকারের দখল নেওয়া। আর সিপিএম-বিজেপি চাইছে ‘গনি-মিথ’ ভেঙে নিজেদের স্বতন্ত্র উপস্থিতি প্রমাণ করতে। সব মিলিয়ে এ বার মালদহে ভোটের লড়াই যেন ‘গনি বনাম গনি’র!

সাবেক মালদহ কেন্দ্র ২০০৯ সালেই ভেঙে দু’টুকরো হয়েছে। মালদহ উত্তর এবং দক্ষিণ। সে বার মালদহ দক্ষিণে জয়ী হয়েছিলেন বরকত-ভ্রাতা আবু হাসেম (ডালু) খান চৌধুরী। পরে কেন্দ্রে মন্ত্রী হয়েছেন তিনি। আর মালদহ উত্তরে জিতেছিলেন তাঁদের ভাগ্নী মৌসম বেনজির নূর। এ বারও দু’টি কেন্দ্রে তাঁরাই প্রার্থী। ডালুবাবু বলেন, “কংগ্রেস মানে যেমন উন্নয়ন, তেমনই দাদার নাম মানেও উন্নয়ন।” হবিবপুরের হালদারপাড়ায় প্রচারের ফাঁকে মৌসমেরও স্পষ্ট স্বীকারোক্তি, “বরকত মামা আমার প্রেরণা। উনি এত কাজ করেছেন, এখানকার মানুষ ওঁকে ভুলতে পারবেন না!”

Advertisement

ডালুবাবু-মৌসমের হাত থেকে গনি খানের এই উত্তরাধিকার কেড়ে নিতে মরিয়া তৃণমূল। দল প্রতিষ্ঠার পরে মালদহে এ বারই প্রথম প্রার্থী দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দুই প্রার্থীরই দাবি, তাঁরা গনি পরিবারের ঘনিষ্ঠ। মালদহ দক্ষিণের তৃণমূল প্রার্থী। চিকিৎসক মোয়াজ্জেম হোসেন যেমন বলছেন, তিনিই গনির ‘আসল শিষ্য’। ফলে “বরকতদা’র কাজ আমরাই করতে পারব।” আর উত্তরের তৃণমূল প্রার্থী, গায়ক সৌমিত্র রায় স্পষ্টই মানেন, “মালদহে বরকত জেঠু লিজেন্ড! একটা মিথ!”

বস্তুত, গত তিন বছর ধরেই এই মিথ দখলের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তৃণমূল নেত্রী। ইতিমধ্যেই তিনি দলে টেনেছেন গনির অপর এক ভাগ্নী শাহনাজ কাদরিকে। এখন তিনি রাজ্য মহিলা কমিশনের ভাইস চেয়ারপার্সন। আর গত রাজ্যসভার ভোটের প্রাক্কালে কংগ্রেসের বদলে তৃণমূল প্রার্থীকে ভোট প্রায় দিয়েই ফেলেছিলেন ডালুবাবুর দাদা সুজাপুরের বিধায়ক আবু নাসের (লেবু) খান চৌধুরী! শেষ পর্যন্ত ডালুবাবুর হস্তক্ষেপে লেবুবাবু ক্ষান্ত হন।

তৃণমূলের যদি লক্ষ্য হয় কংগ্রেসের হাত থেকে গনির উত্তরাধিকার কেড়ে নেওয়া, বিজেপি-সিপিএমের উদ্দেশ্য তা হলে তাঁর প্রভাব মুছে ফেলা। এবং তাদের আশা, এ বার মালদহে কংগ্রেসের জমি অনেকটাই দখল করা যাবে।

মালদহ দক্ষিণের বিজেপি প্রার্থী বিষ্ণুপদ রায় সরাসরি বলছেন, “দিল্লিতে যেমন আমরা পরিবারতন্ত্র ভাঙার ডাক দিয়েছি, এখানেও তা-ই। আমরা বলছি, ওই গনি মাদুলি পরে আর চলবে না!’’ প্রায় একই সুর শোনা গেল এই কেন্দ্রের সিপিএম প্রার্থী আবুল হাসনাত খানের গলাতেও। তাঁর তির্যক মন্তব্য, ‘‘মামা-ভাগ্নীর গনি ভজনার ফাটা রেকর্ড বাজানো এ বার বন্ধ করতে হবে!” শুনে মৌসমের আবার পাল্টা কটাক্ষ, “ওঁদের তো কোনও রেকর্ডই নেই! ওঁদের কথা কে শুনবে?”

ফরাক্কায় প্রচারে এসে সিপিএম প্রার্থীর অভিযোগ, গত পাঁচ বছরে মালদহে উন্নয়নের কাজ কিছুই হয়নি। সাংসদ মামা-ভাগ্নীকে এলাকায় দেখা যায় না বলে একই অভিযোগ করছে বিজেপি, তৃণমূলও। মৌসমের জবাব, “বিরোধীরা তো বলবেই, আমাদের দেখা যায় না। না হলে ওরা ভোট পাবে কী করে!” সেই সঙ্গে তাঁর কেন্দ্রের উন্নয়নে তিনি কী কী করেছেন তার ফিরিস্তি দিয়ে ১৮ পাতার একটি পুস্তিকাও বিলি করছেন মৌসম। ডালুবাবু এখনও কোনও পুস্তিকা বা প্রচারপত্র করেননি। জেলা কংগ্রেস সম্পাদক শ্যামাপদ চৌধুরীর কথায়, “গঙ্গার বন্যায় মালদহ শহর বাঁচাতে বাঁধ তৈরি করা থেকে শুরু করে এলাকার উন্নয়নে যা কাজ ডালুদা করেছেন, স্থানীয় বাসিন্দারা সব জানেন।” ডালুবাবু নিজেও বলছেন, “কংগ্রেস মানেই উন্নয়ন। সেই উন্নয়ন এখানে দাদা করে গিয়েছেন। আমরাও করছি।”

এই প্রেক্ষাপটে সিপিএমের হাসনাত বা উত্তরের প্রার্থী খগেন মুর্মু নিবিড় প্রচারে গুরুত্ব দিয়েছেন। জাতীয় স্তরে কংগ্রেসের দুর্নীতির পাশাপাশি তিন বছরে মমতা-সরকারের আমলে রাজ্যের বেহাল আইন-শৃঙ্খলার অভিযোগকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন তাঁরা। বিজেপি-র প্রার্থী বিষ্ণুবাবু বা মালদহ উত্তরের প্রার্থী, অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক সুভাষকৃষ্ণ গোস্বামী কিন্তু কংগ্রেস এবং তৃণমূলকেই প্রধান প্রতিপক্ষ বলে মনে করছেন। গত বার উত্তরে বিজেপি পেয়েছিল প্রায় ৭% ভোট। আর দক্ষিণ কেন্দ্রে ভোট ছিল ৫.৩০%। এ বার কত ভোট

তাঁরা পেতে পারেন? সুভাষবাবুর দাবি, “আমাদের ভোট কয়েক গুণ বাড়বে। সারা দেশে মোদী ঝড় উঠেছে। মালদহে সেই ঝড়ে কংগ্রেস উড়ে যাবে।”

ঝড় মালদহে এখনই উঠেছে। তবে তা ধুলোর ঝড়! হু হু করে হুড খোলা জিপ, গোটা দু’য়েক গাড়ি আর গোটা ছয়েক বাইক নিয়ে তেড়ে প্রচার করছেন ‘ভূমি-পুত্র’ সৌমিত্র। ওল্ড মালদহের গোঁসাই পাড়া থেকে আদিনা স্টেশনের দিকে ‘রোড শো’ করছিলেন। মহিলা কংগ্রেসের প্রাক্তন রাজ্য সভানেত্রী মঞ্জুলা রায়ের পুত্র এবং ‘ভূমি’র গায়ক সৌমিত্র সরাসরি বললেন, “যতই গান করি, স্থানীয় মানুষ আমাকে চেনেনই না। কিন্তু একে দিদির দলের প্রার্থী, তার উপরে ডাক্তার পিনাকীরঞ্জন রায়ের ভাইপো শুনে অনেকেই আগ্রহ দেখাচ্ছেন।” সৌমিত্রর আশা, “দিদি এবং মিঠুনদা আসবেন শুনছি। ওঁরা এলে মানুষের আগ্রহ তুঙ্গে উঠবে।” দলের অপর প্রার্থী মোয়াজ্জেমও ব্যাপক প্রচার করছেন।

জেলার দুই মন্ত্রী সাবিত্রী মিত্র এবং কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরীও প্রার্থীদের নিয়ে ঘুরছেন। যদিও দুই মন্ত্রীর সম্পর্ক বড়ই ‘মধুর’! ভোটে তৃণমূলের জয় নিশ্চিত কি না, জানতে চাইলে কৃষ্ণেন্দুর কৌশলী জবাব, “আমরা লড়াইয়ের জায়গাটা তৈরি করে নিয়েছি।”

জেলা পরিষদ হাতে রয়েছে, দুই লোকসভা কেন্দ্রের অর্ন্তগত ১৪ বিধানসভার মধ্যে ৮টি কংগ্রেসের দখলে। তাই হবিবপুরের প্রত্যন্ত গ্রামে কর্মিসভায় যাওয়ার আগে মৌসমের মন্তব্য, “এখনও মালদহে কংগ্রেস প্রথম। বামেরা দ্বিতীয়। বাকিরা তৃতীয় বা চতুর্থ স্থানে থাকতে পারে!”

লড়াইয়ে তৃণমূল এখানে কোথায় থাকে, এ বার সেটাই দেখার!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন