মাংস কাটবে, রক্ত পড়বে না! হয় নাকি?

আইন আছে। তবে তা তো চাপা পড়ে থাকে। ব্যবহার হয় না। সেই আইনকে কার্যকর করতে কেন্দ্রের নির্দেশটার কথা শুনে শাইলকের ঘটনা মনে পড়ে গেল হঠাৎ। বিচারকের সেই বিধান: ‘মাংস কাটতে পারো, রক্ত যেন না পড়ে।’ এ তো খানিকটা সে রকমই। রাস্তায় দোকানে-দোকানে সিগারেট আছে। তা কেনাও যাবে।

Advertisement

সমরেশ মজুমদার

শেষ আপডেট: ২৪ মে ২০১৪ ০৩:৩৫
Share:

আইন আছে। তবে তা তো চাপা পড়ে থাকে। ব্যবহার হয় না। সেই আইনকে কার্যকর করতে কেন্দ্রের নির্দেশটার কথা শুনে শাইলকের ঘটনা মনে পড়ে গেল হঠাৎ। বিচারকের সেই বিধান: ‘মাংস কাটতে পারো, রক্ত যেন না পড়ে।’ এ তো খানিকটা সে রকমই। রাস্তায় দোকানে-দোকানে সিগারেট আছে। তা কেনাও যাবে। অথচ রাস্তায় দাঁড়িয়ে সে সিগারেট খাওয়া যাবে না!

Advertisement

বিশ্বজোড়া আন্দোলনের ফলে এখন কমবয়সীরা অনেকেই সচেতন। তরুণ প্রজন্মের প্রায় ৯০ শতাংশই তো দেখি সিগারেট খায় না বা পছন্দ করে না। আমাদের এই বয়সে তো তেমনটা ছিল না। আমাদের মধ্যে ৪০ শতাংশ সিগারেট খাওয়ার ইচ্ছেটা চাপা দিয়ে রাখতে পারত না কিছুতেই। ৫০ শতাংশ হয়তো বা বাবা-মায়ের শাসনের ভয়ে খেত না। আমি অবশ্য বরাবরই ওই ৪০ শতাংশের দলে। কিছুতেই সিগারেট না খেয়ে থাকতে পারিনি। এখনও পারি না। লিখতে বসলেও সিগারেট লাগে।

অসুস্থ হয়েছি। সবাই নানা রকম ক্ষতি হয়ে যাওয়ার ভয় দেখিয়েছে। তুমুল কাশির চোটে কিছুদিন বন্ধ রেখেছি হয়তো। কিন্তু সুস্থ হতেই আবার যে-কে-সেই। আমার মেয়েরা অবশ্য সিগারেট খাওয়া মোটে পছন্দ করে না, গন্ধটাই সহ্য করতে পারে না। ওরা ঘরে থাকলে তাই খাই না। তার মানে সিগারেট না খেয়ে থাকতে পারি না, এমনটা নয়। সেই আমিই আবার বিদেশ যাওয়ার সময়ে আগে প্লেনে স্মোকিং জোনে সিট চেয়ে নিতাম। এখন স্মোকিং জোনের ব্যবস্থাটাই বদলেছে। ফলে সিগারেট খেতে চাইলে ট্রানজিটে কিংবা প্লেনে ওঠার আগে বিমানবন্দরের কর্মীরা স্মোকিং রুম দেখিয়ে দেন। তা সে ঘর তো প্রায় প্লেন থেকে সিকি মাইল দূরে। ঘরের দরজা খুললেই কী বিকট গন্ধ। আমিই ভিতরে ঢুকতে না পেরে সিগারেট খাওয়া থেকেই বিরত থাকি। গন্তব্যে পৌঁছে হয়তো প্লেন থেকে নেমেই হাতটা সটান চলে যায় পকেটে। কিন্তু তার মানে ২২-২৩ ঘণ্টা তো দিব্যি না খেয়ে থাকতে পারি। মহাকাশে যেতে হলে হয়তো বা ২-৩ মাসও কাটিয়ে ফেলতে পারতাম।

Advertisement

তা হলে সেই আমিই সিগারেট ছাড়তে পারি না কেন? এত অসুস্থতার আশঙ্কা, প্যাকেটের গায়ে বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ কোনও কিছুরই পরোয়া করি না কেন? সিগারেট খেয়ে অনেকেই নানা রকম অসুখে আক্রান্ত হন, পরোক্ষ ভাবে অন্যের সিগারেটের ধোঁয়া গিলেও কত জনের কত সমস্যা হয়। তবু বছরের পর বছর সিগারেট খেয়েও সুস্থ আছেন, এমন মানুষও তো আছেন। সাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরীই তো তেমন মানুষ। আশি বছর পেরিয়েও (নাকি নব্বই) সিগারেট-জনিত কোনও সমস্যায় তো ভুগতে দেখিনি ওঁকে! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে উইনস্টন চার্চিল আর চুরুটের আলাদা করে অস্তিত্ব বোঝা মুশকিল হত। সেই সময়েই এক বার অসুস্থ হওয়ায় এক তরুণ ডাক্তার তাঁকে সিগারেট ছাড়তে বলেন। চার্চিল তাঁকে পাল্টা প্রশ্ন করেন, সিগারেট খেলে তিনি ক’দিন বাঁচবেন, আর না খেলেই বা ক’দিন। তরুণ ডাক্তারটি কোনও উত্তর দিতে পারেননি।

আমার এক বন্ধু এক বার সিগারেট খাওয়ার অদম্য ইচ্ছেটাকে চাপা দিতে না পেরে নিউ ইয়র্কে নেমেই সিগারেট ধরিয়েছিলেন। বিমানবন্দরের কর্মীরা জরিমানার ভয় দেখালে তিনি নির্বিবাদে আর একটা সিগারেট ধরাতে চান। বলেন, ‘জরিমানাই যখন করবেন, আর একটা খেয়েনি বরং!’

জরিমানার কথাতেই আসি। সারা বিশ্বে যখন সিগারেট বন্ধে এত আন্দোলন চলছে, তখন সারদা আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করতে স্বয়ং আমাদের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সবাইকে বেশি করে সিগারেট খেতে উৎসাহ দিয়েছেন। কারণ সিগারেট কিনলে যে করের টাকা আসবে, তাতেই ওই টাকার জোগান হবে। এ দিকে, কেন্দ্র তো বলছে সিগারেট খেলে জরিমানা হবে। তবে কি রাস্তায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খেলে যে পুলিশকর্মী জরিমানা করতে আসবেন, তাঁকে জিজ্ঞেস করব, তিনি রাজ্যের না কেন্দ্রের চাকুরে? রাজ্যের হলে সিগারেট খেতে নিষেধ করা মানে তো তিনি স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীকে অমান্য করছেন!

আসলে এ ভাবে সিগারেট খাওয়া বন্ধ করা মুশকিল। সত্যিই বন্ধ করতে গেলে আগে দোকানগুলোকে বন্ধ করতে হবে। না হলে ওই শাইলকের গল্প! কিংবা যে সিগারেট এখানে ১৭০ টাকায় পাওয়া যায়, সেটাই নিউ ইয়র্কে ১৫ ডলার। মানে আমাদের প্রায় ৯০০ টাকা। অত টাকা দিয়ে আমি কিনি না তো! তাই দোকান বন্ধ করা না গেলে না হয় সিগারেটের দামগুলো হাতের নাগালের বাইরে নিয়ে যাওয়া হোক। এ সব করা গেলে তবেই হয়তো আইনটা যথার্থ ভাবে প্রয়োগ করা যাবে। জরিমানা-অসুস্থতার ভয়ে সিগারেট ছাড়ার মতো মানসিকতা বোধ হয় আমাদের অনেকেরই নেই। সিগারেট থেকে দূরে থাকার মতো মনের জোরটাও নেই।

আসলে সিগারেট নিয়ে এত ভয় দেখানো হয় বটে, কিন্তু তার বাইরেও কত কী বিষ তো রোজ আমাদের শরীরে ঢুকে পড়ছে। রাস্তায় বেরোলেই এত গাড়িঘোড়ার বিষাক্ত ধোঁয়া, খাবার খেলেই কৃত্রিম রং, ফলমূল-শাকসব্জিতে এত রকম রাসায়নিক। সে জন্যই বোধ হয় সিগারেটের বিষ ধূমপায়ীদের সে ভাবে ভয় ধরাতে পারে না।

আমি নিজেই তো কত বার ছেড়েছি। ফের ধরেছি। সিগারেটটা আসলে বড় ভালবাসার জিনিস।

আর কে না জানে ভালবাসা বুকে ক্ষত সৃষ্টি করে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন