মাস্টারমশাই কিছুই দেখেননি, বলছে আতঙ্কের দিনলিপি

বঙ্গে এ বারের লোকসভা নির্বাচন ফিল্মি-রঙ্গে ভরা! রুপোলি পর্দার তারকারা তৃণমূলের প্রার্থী হয়েছেন। পর্দার পিছনের গায়কেরা দাঁড়িয়েছেন বিজেপি-র হয়েও। সরাসরি চলচ্চিত্র জগতের সাহায্য না নিয়েও এ বার ফিল্মি ডায়লগ থেকে তৈরি পুস্তিকাকে অস্ত্র করল সিপিএম!

Advertisement

সন্দীপন চক্রবর্তী

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:৪৫
Share:

বামেদের সেই পুস্তিকা

বঙ্গে এ বারের লোকসভা নির্বাচন ফিল্মি-রঙ্গে ভরা! রুপোলি পর্দার তারকারা তৃণমূলের প্রার্থী হয়েছেন। পর্দার পিছনের গায়কেরা দাঁড়িয়েছেন বিজেপি-র হয়েও। সরাসরি চলচ্চিত্র জগতের সাহায্য না নিয়েও এ বার ফিল্মি ডায়লগ থেকে তৈরি পুস্তিকাকে অস্ত্র করল সিপিএম!

Advertisement

‘আপনি কিন্তু কিছুই দেখেননি মাস্টারমশাই’! প্রয়াত পরিচালক তপন সিংহের ‘আতঙ্ক’ ছবির এই বিখ্যাত সংলাপ এ বার ফিরে এসেছে নির্বাচনী ময়দানে। ওই সংলাপ ব্যবহার করেই তৈরি হয়েছে একটি পুস্তিকা। যার মাধ্যমে শিক্ষা জগতের বিবেকের কাছে আবেদন করছে বাম শিবির। পুস্তিকাটি আসলে ‘পরিবর্তনের জমানায় শিক্ষা জগতে তাণ্ডবের দিনপঞ্জিকা’। তৃণমূলের সরকারের আমলে গত আড়াই বছরে শিক্ষাঙ্গনে নৈরাজ্য, আক্রমণ বা তাণ্ডবের যত ঘটনা ঘটেছে, সাল-তারিখ উল্লেখ করে তারই সংক্ষিপ্ত বিবরণ পেশ করা হয়েছে এই বইয়ের পাতায় পাতায়। সঙ্গে রয়েছে ওই সমস্ত ঘটনার সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর ও ছবির ছোট প্রতিলিপি। পুস্তিকায় মতামত বিশেষ নেই। শুধু ঘটনাপঞ্জি উল্লেখ করে আবেদন। যে আবেদন করে শিক্ষা জগতের বিবেকের কাছে জানতে চাওয়া হচ্ছে, শিক্ষাঙ্গনে এমন আতঙ্কের দিনলিপি কি তাঁরা মেনে নিতেই থাকবেন?

যুগের সঙ্গে তাল রেখে এবং আধুনিক মনকে ধরতে এ বার প্রচারের কায়দায় অনেকটাই পরিবর্তন এনেছে সিপিএম। চিরাচরিত লাল-সাদা বইয়ে তৎসম শব্দে ভারাক্রান্ত প্রচার পুস্তিকা না-করে বিষয় ধরে ধরে আলাদা আলাদা বই বাজারে এনেছে তারা। যার লক্ষ্য মানুষের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ। সমাজের আলাদা আলাদা অংশের মানুষের সমস্যা উল্লেখ করে সেই অংশের কাছে পৌঁছনোর চেষ্টাও হয়েছে। সেই উদ্যোগেরই অঙ্গ শিক্ষা জগতের জন্য এই দিনপঞ্জিকা। সরাসরি সিপিএমের নয়, এই বইয়ের প্রকাশক অবশ্য ন্যাশনাল বুক এজেন্সি। মূলত শিক্ষা জগতের জন্য নির্দিষ্ট বলেই বিনামূল্যে বিতরণও করা হচ্ছে না। কিন্তু তার শিরোনাম থেকে গোটা আঙ্গিকে ভিন্ন চিন্তাভাবনার ছাপ স্পষ্ট।

Advertisement

প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা, রায়গঞ্জে অধ্যাপককে নিগ্রহ, ভাঙড় কলেজে অধ্যাপিকাকে হেনস্থা, এমনকী ক্রাইস্ট চার্চ স্কুলের ঘটনা সবই স্থান পেয়েছে বইয়ে। কিছু শিক্ষক-শিক্ষিকাই তথ্য জোগাড় করে এই সংকলন হাতে-কলমে তৈরি করেছেন। আর সেখানে বলা হয়েছে, ‘আমরা এ রাজ্যের শিক্ষানুরাগী মানুষের কাছে আবেদন করব সংকলনটি পড়ে দেখার জন্য, নিজের কাছে রাখার জন্য। বই ওল্টাতে ওল্টাতে গা শিউরে উঠবে’! তার সঙ্গেই রয়েছে: ‘বহু বহু বছর পরে এর একটা কপিও যদি কোথাও অবশিষ্ট থাকে, তবে সে দিনের উত্তরপুরুষ অন্তত এটুকু বুঝবে আমাদের পূর্বসূরিরা অন্যায়কে মেনে নেননি’।

বামপন্থী শিক্ষকদের এমন আবেদন মেনে নিতে স্বাভাবিক ভাবেই রাজি নয় তৃণমূল সরকার। পেশায় অধ্যাপক, শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর মতে, পঞ্চায়েত, পুরভোট বা নানা উপনির্বাচনে মানুষের রায় সামনে এসেছে। এই বই যদি লোকসভা ভোটের জন্য হয়, তা হলে ভোটের পরই রায় বুঝে যাবেন প্রকাশকেরা! এই দাবির পাশাপাশিই আরও একটি প্রসঙ্গ তুলছেন শিক্ষামন্ত্রী। তপনবাবুর ‘আতঙ্ক’ ছবি তৈরি হয়েছিল বাম জমানায় এক শিক্ষকের জীবনের সত্য ঘটনা অবলম্বনে। এখন তাঁর ছবির ওই সংলাপ ব্যবহার করা মানে প্রকারান্তরে এটাও মনে করানো যে, বাম জমানায় কী ঘটত! ব্রাত্যবাবুর কথায়, “তপনবাবুকে জীবদ্দশায় বাম সরকার সম্মান দেয়নি। সে কথা উনি বলে গিয়েছিলেন। এখন তাঁর ছবির সংলাপ নিয়ে এই প্রচার লাশ নিয়ে রাজনীতির মতোই নিন্দনীয়!” ঘটনাচক্রে, তপনবাবুর সেই ছবির দুই কুশীলব শতাব্দী রায় ও নিমু ভৌমিক এ বার ভোট ময়দানে আছেন তৃণমূল ও বিজেপি-র প্রার্থী হয়ে!

বাম জমানার এক প্রাক্তন মন্ত্রী অবশ্য মনে করিয়ে দিচ্ছেন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় গাদা গাদা পুরস্কারের চল আগে ছিল না ঠিকই। কিন্তু তা-ই বলে তপনবাবুকে স্বীকৃতি না দেওয়ার প্রশ্ন অবান্তর। তপনবাবু এক বার কলকাতায় চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধকও ছিলেন। আর সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য এবং যাদবপুরের প্রার্থী সুজন চক্রবর্তী বলছেন, “যে তথ্য ওই বইয়ে আছে, তার কোনও জবাব খুঁজে না পেয়ে মন্ত্রী এমন বলছেন!”

শিক্ষক এবং প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক অঞ্জন বেরার বক্তব্য, “শুধু শিক্ষা জগতই নয়, এই বই সকলের জন্য। শিক্ষাঙ্গনে আক্রমণের ফলে উদ্বেগ তো শুধু শিক্ষা জগতেই সীমাবদ্ধ নয়।” আর এক অধ্যাপক, দক্ষিণ কলকাতার সিপিএম প্রার্থী নন্দিনী মুখোপাধ্যায় বলছেন, “সংবাদমাধ্যমে যা বেরিয়েছে, নিজে শিক্ষকতার সুবাদে তার বাইরেও আরও কিছু ঘটনা জানি। সে সবই প্রচারে বলছি।” তবে কংগ্রেস শিবিরের প্রাক্তন শিক্ষক, শ্রীরামপুরের প্রার্থী আব্দুল মান্নানের খোঁচা, “আমরা কিন্তু প্রচারে বলছি, সিপিএম থেকে তৃণমূল পতাকার রংই শুধু বদলেছে! আতঙ্কের কাহিনি একই আছে!”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন