মতুয়ারা কি নাগরিক নন, মমতার প্রশ্নে বিড়ম্বিত মঞ্জুল

মতুয়া ভোটব্যাঙ্কের উপরে অধিকার যে তাঁরই, তা প্রমাণে ফের সচেষ্ট হলেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বনগাঁ লোকসভার উপনির্বাচনকে সামনে রেখে মতুয়া ভোটব্যাঙ্কে ফাটল ধরাতে ইতিমধ্যেই আসরে নেমেছে বিজেপি। হাবরায় সভা করে রবিবারই সেই বার্তা দিয়েছেন দলের রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ। তার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই মমতা বোঝাতে চাইলেন, মতুয়ারা আসলে তাঁরই লোক। এই কাজে তিনি ব্যবহার করলেন সরকারি মঞ্চকেই।

Advertisement

সীমান্ত মৈত্র

বনগাঁ শেষ আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০১৪ ০৩:২৬
Share:

বনগাঁয় পৌঁছলেন মুখ্যমন্ত্রী। সোমবার। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক

মতুয়া ভোটব্যাঙ্কের উপরে অধিকার যে তাঁরই, তা প্রমাণে ফের সচেষ্ট হলেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বনগাঁ লোকসভার উপনির্বাচনকে সামনে রেখে মতুয়া ভোটব্যাঙ্কে ফাটল ধরাতে ইতিমধ্যেই আসরে নেমেছে বিজেপি। হাবরায় সভা করে রবিবারই সেই বার্তা দিয়েছেন দলের রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ। তার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই মমতা বোঝাতে চাইলেন, মতুয়ারা আসলে তাঁরই লোক। এই কাজে তিনি ব্যবহার করলেন সরকারি মঞ্চকেই।

Advertisement

বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের উদ্বোধন, শিলান্যাস, কৃষি সরঞ্জাম ও সাইকেল বিলির মতো কাজে সোমবার বনগাঁয় এসেছিলেন মমতা। স্থানীয় একগুচ্ছ প্রকল্পের ঘোষণা করে এ দিন রীতিমতো কল্পতরু মেজাজে ছিলেন তিনি। বনগাঁ স্টেডিয়ামের মঞ্চে সে সব কাজ মিনিট পনেরোর মধ্যে সেরে ফেলে মমতা ঢুকে পড়েন রাজনৈতিক বক্তৃতায়।

মতুয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “মাঝে এক বার শুনেছিলাম, মতুয়া পরিবারকে নাগরিকত্ব দেবে। কিন্তু মতুয়ারা তো ইতিমধ্যেই নাগরিকত্ব পেয়ে গিয়েছে।” মঞ্চে স্বভাবসিদ্ধ ঢঙে পায়চারি করতে করতে মমতার চোখ পড়ে এক কোণে বসে থাকা মতুয়াবাড়ির ছোটছেলে তথা রাজ্যের মন্ত্রী মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুরের দিকে। আচমকাই তাঁর দিকে মাইক্রোফোন বাড়িয়ে দিয়ে মমতা জানতে চান, “কি মঞ্জুল, তোমরা এ দেশের নাগরিক নও?” থতমত খেয়ে মঞ্জুল কোনও জবাব দেননি। আবার প্রশ্ন আসে, “বলো, তোমরা কি দেশের নাগরিক হওনি?” মঞ্জুল মনে হয় তখনও বুঝে উঠতে পারেনি, ঠিক কী উত্তর আশা করছেন দলনেত্রী। তৃতীয় বার প্রশ্নের সামনে পড়ে মাইকের সামনে ঘাড় হেলিয়ে মঞ্জুল বলেন, “হ্যা।”ঁ উত্তরে তৃপ্ত নেত্রী এ বার বলেন, “জানে না কিছুই, ওরা তো নাগরিকই। বড়মা এ দেশের নাগরিক নন? কপিল (প্রয়াত সাংসদ কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর) নাগরিক নন? তিনি মারা গিয়েছেন। কিন্তু ওঁর পরিবার এ দেশেরই নাগরিক।” এ প্রসঙ্গেই বিজেপির নাম না করে তৃণমূল নেত্রীর কটাক্ষ, “একটা জিনিস তো জেনে বলতে হয়!”

Advertisement

মমতার জানা তথ্যের ভিত্তিতে অবশ্য নতুন গোল বেধেছে। কী রকম?

সোমবার থেকেই গাইঘাটা-বনগাঁর নানা প্রান্তে মতুয়া মহাসঙ্ঘের সাধারণ সম্পাদক সুব্রত ঠাকুরের নামে লিফলেট বিলি হচ্ছে। যেখানে উদ্বাস্তু বাঙালিদের (হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-মতুয়া) নিঃশর্ত নাগরিকত্বের দাবিতে আমরণ অনশনের ডাক দেওয়া হয়েছে। ২৭ নভেম্বর মতুয়াদের পীঠস্থান গাইঘাটার ঠাকুরবাড়িতে সেই কর্মসূচি নেওয়ার কথা। বস্তুত, মতুয়াদের একটি অংশ ভারতীয় নাগরিকত্ব পেলেও বৃহত্তর উদ্বাস্তু সমাজের জন্য নাগরিকত্বের দাবিতে মতুয়ারা দীর্ঘ দিন ধরে আন্দোলন চালাচ্ছেন। কাজেই সব মতুয়া ভারতীয় নাগরিক হয়ে গিয়েছেন বলে মমতা এ দিন যে কথা প্রমাণ করতে চেয়েছেন, তার সারবত্তা খুঁজে পাচ্ছেন না মতুয়াদের একাংশই। লিফলেটে উদ্বাস্তুদের নানা সমস্যা নিয়ে কেন্দ্রে বিজেপি এবং এ রাজ্যের পূর্বতন বাম সরকারের সমালোচনা করা হয়েছে। পাশাপাশি লেখা হয়েছে, ‘দুঃখের হলেও এ কথা সত্যি, তৃণমূল সরকার ও দল এখনও পর্যন্ত উদ্বাস্তুদের জন্য তেমন গুরুত্বপূর্ণ কোনও পদক্ষেপ করেনি।’

মতুয়াদের এই লিফলেট ও কর্মসূচির কথা মমতা তখনও জানতেন না বলেই ধরে নেওয়া যায়। কিন্তু মঞ্চে বসে মুখ্যমন্ত্রীর হ্যাঁ-এ হ্যাঁ মিলিয়ে দেওয়া মন্ত্রী মঞ্জুল কী বলছেন? তিনি পরে বলেন, “মতুয়াদের বেশির ভাগই নাগরিক হয়েছেন। কিন্তু ২০০৩ সালে কেন্দ্রে এনডিএ-র আমলে যে নাগরিকত্ব আইন হয়েছিল, তার বদল চেয়ে আমরা আন্দোলন করছি।” মঞ্জুলের ছেলে সুব্রত অবশ্য এ বিষয়ে সরাসরি মন্তব্য এড়িয়ে গিয়েছেন। তিনি বলেন, “উনি (মমতা) কী অর্থে এ কথা বলেছেন, তা না জেনে মন্তব্য করব না।”

মমতা আরও বলেন, “ওরা (বিজেপি) বলেছিল ভোটের (লোকসভা) পরে বাংলাদেশ থেকে যারা এ পারে এসেছে, তাদের লোটা-কম্বল সুদ্ধ তাড়িয়ে দেবে। তখন কি বলেছিলাম মনে আছে?” একই প্রশ্ন বার তিনেক শোনার পরে উপস্থিতি হাজার কুড়ি জনতার মধ্যে থেকে উত্তর ভেসে আসে, ‘হ্যাঁ হ্যা।ঁ’ মমতা নিজেই অবশ্য সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে বলেন, “তখন বলেছিলাম, সাহস থাকলে কারও গায়ে হাত দিয়ে দেখুক। যারা বাংলাদেশ থেকে এ পারে এসেছে, তারা অবশ্যই ভারতের নাগরিক। অতীতে আমরা একটাই দেশ ছিলাম। বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের বন্ধন রয়েছে।” মমতার বক্তব্য, যদি কেউ সন্ত্রাসবাদী হয়, তা হলে সন্ত্রাসবাদী হিসাবেই তার বিচার হোক। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে যারাই এ দেশে এসে নাগরিক হয়েছেন তারাই অনুপ্রবেশকারী, এ কথা বলা হচ্ছে কী ভাবে?

মঞ্চ থেকে এ দিন বিজেপি এবং সংবাদমাধ্যমের একাংশকে স্বভাবসিদ্ধ ঢঙে তুলোধোনা করেছেন মমতা। তার ঘণ্টা কয়েকের মধ্যেই কলকাতায় দলীয় সভার এক রকম ‘স্টেজ রিহার্সাল’ই সেরে নিয়েছেন বনগাঁয়, সরকারি মঞ্চ থেকে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন