বিধানসভায় শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় দাবি করছেন, রাজ্যের খুব সামান্য কয়েকটি কলেজেই গোলমাল হয়েছে। সভার বাইরে তাঁর আরও দাবি, শিক্ষায় অশান্তি কমেও এসেছে। একই দিনে খাস কলকাতার একটি কলেজ এবং খড়্গপুর কলেজে চলল ধুন্ধুমার কাণ্ড। শিক্ষায় অশান্তি আর মন্ত্রীর দাবির এই বৈপরীত্যের সাক্ষী থাকল মঙ্গলবার।
শিক্ষা-প্রাঙ্গণকে হিংসামুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোটে নেমেছিল তৃণমূল। কিন্তু কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের গোলমালে মূলত আঙুল উঠছে তাদের ছাত্র শাখার দিকেই। মাত্র চার মাসে রাজ্যের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সংঘর্ষ-অশান্তির অন্তত ১৪টি ঘটনা ঘটেছে। অথচ শিক্ষামন্ত্রী এ দিন বিধানসভায় দাবি করেন, রাজ্যে ৮২৬টি কলেজের মধ্যে গোটা দশেক প্রতিষ্ঠানে কিছু অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। আর তা নিয়েই বলা হচ্ছে, শিক্ষায় নৈরাজ্যের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। মন্ত্রীর দাবিকে বিদ্রুপ করেই যেন এ দিন হাঙ্গামা হয় দু’টি কলেজে। দু’টিতেই বহিরাগতদের নিয়ে সমস্যা এবং ফের অভিযুক্ত তৃণমূল ছাত্র পরিষদ (টিএমসিপি)।
একটি ঘটনা খড়্গপুর কলেজের। অশান্তির অন্য ঘটনাটি ঘটেছে খাস কলকাতার আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু কলেজে। দ্বিতীয়টিতে জগদীশচন্দ্র বসু কলেজের অধ্যক্ষ আহত হন বলে অভিযোগ। সেখানে ঠিক কী ঘটেছে?
ওই কলেজের ক্যান্টিনের দখল নিয়ে এ দিন বেলা আড়াইটে নাগাদ এক দল বহিরাগত যুবকের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে পড়ুয়াদের। বহিরাগতেরা কলেজের ভিতরে ঢুকে ছাত্রদের মারধর করে এবং অধ্যক্ষের ঘরে ভাঙচুর চালায় বলে অভিযোগ। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দুপুরে এক দল যুবক আচমকাই কলেজে ঢুকে পড়ে। কলেজের ছাত্রদের একাংশ তাদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করায় বচসা বাধে, মারামারি হয়। এর পরে বহিরাগতেরা চলে যায় কলেজের অধ্যক্ষের ঘরের সামনে। নিরাপত্তারক্ষীদের ঠেলে তারা ঢুকে পড়ে অধ্যক্ষ শান্তনু লাহার ঘরে।
শান্তনুবাবু বাধা দিলে তাঁর সঙ্গেও বচসা বাধে বহিরাগতদের। সেই সময় কলেজের ছাত্রদের একাংশও ঢুকে পড়েন অধ্যক্ষের ঘরের ভিতরে, শুরু হয় মারামারি। পরে বহিরাগতেরা তাঁর ঘরে ভাঙচুর চালায় বলে শান্তনুবাবুর অভিযোগ। পুলিশের কাছেও এই নিয়ে অভিযোগ জানিয়েছেন অধ্যক্ষ। অভিযুক্তদের শাস্তির দাবিতে কলেজের ছাত্রেরা পরে শেক্সপিয়র সরণি থানার সামনে অবস্থানে বসেন।
শান্তনুবাবু সন্ধ্যায় বলেন, “এক দল বহিরাগত আমার ঘরে ঢুকে ভাঙচুর করে। তাদের কলেজ সংক্রান্ত অনেক দাবি ছিল। এই নিয়ে উত্তেজনা তৈরি হয়। গোলমালের মধ্যে পড়ে যাওয়ায় আমার বুকে লাগে।”
আঙুল উঠছে শাসক দলের ছাত্র সংগঠনের দিকেই। তবে টিএমসিপি এ দিনের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছে। সংগঠনের রাজ্য সম্পাদক সুজিত শাম বলেন, “এই ঘটনায় টিএমসিপি জড়িত নয়। ওই কলেজের ছাত্র সংসদ ছাত্র পরিষদের দখলে। এটা ওদের গোষ্ঠী-কোন্দলের ফল।” আর ওই কলেজের ছাত্র পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মহম্মদ নাদিম বলেন, “এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতেই এ-সব করছে টিএমসিপি।” নাদিমের অভিযোগ, মারামারিতে কলেজের দু’জন ছাত্র জখম হয়েছেন। পুলিশ অবশ্য জানায়, কারও আহত হওয়ার খবর নেই। কারা হাঙ্গামা বাধাল, কারাই বা অধ্যক্ষের ঘরে ভাঙচুর করল সবই খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
সোম ও মঙ্গলবার গোলমাল হয় খড়্গপুর কলেজে। টিএমসিপি আশ্রিত বহিরাগত দুষ্কৃতীরা কলেজে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে আর ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ তাতে প্রশ্রয় দিচ্ছেন বলে অভিযোগ। সোমবার কলেজে এক দল অপরিচিত যুবকের দাপাদাপিকে ঘিরেই ঘটনার সূত্রপাত। কলেজের ছাত্র সংসদ টিএমসিপি-র দখলে। বহিরাগতদের হাঙ্গামার প্রতিবাদে এ দিন বেলা ১টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ অচিন্ত্যকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ঘরের সামনে অবস্থান-বিক্ষোভ করেন ছাত্র পরিষদ (সিপি)-এর সদস্যেরা। অচিন্ত্যবাবু বহিরাগতদের যাতায়াত বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেওয়ার পরে অবস্থান তুলে নেওয়া হয়।
ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ পরে সংবাদমাধ্যমকে বলেন, “শুনেছি, সোমবার কিছু অপরিচিত যুবক কলেজে ঢুকেছিল। আমি তখন কলেজে ছিলাম না।” তিনি জানান, এখনও সব পড়ুয়া পরিচয়পত্র পাননি। কয়েক দিনের মধ্যেই তা দেওয়া হবে। ১৭ নভেম্বর থেকে সচিত্র পরিচয়পত্র ছাড়া কাউকে কলেজ-চত্বরে ঢুকতে দেওয়া হবে না। তখন বহিরাগতদের মোকাবিলা করা আরও সহজ হবে বলে কলেজ-কর্তৃপক্ষের দাবি।
কিন্তু এ ভাবে তো একের পর এক কলেজে গোলমাল লেগেই আছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অভিযুক্ত টিএমসিপি। সরকার কী করছে?
অনেক দিন ধরেই প্রশ্নটা উঠছে শিক্ষাজগতে। এ দিন বিধানসভায় রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয় বিল নিয়ে আলোচনার সময় শিক্ষামন্ত্রী বলেন, “রাজ্যে ৮২৬টি কলেজ রয়েছে। তার মধ্যে গোটা দশেক প্রতিষ্ঠানে কিছু অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছে। গোটা দশেক প্রতিষ্ঠানের ঘটনা নিয়ে বলা হচ্ছে, শিক্ষা ক্ষেত্রে নৈরাজ্যের পরিবেশ তৈরি হয়েছে!”
শিক্ষামন্ত্রী পরে টেলিফোনে জানান, এ দিন যে কলকাতা এবং জেলার দু’টি কলেজে গোলমাল হয়েছে, সেটা তাঁর কানে পৌঁছয়নি। অভিযোগ পেলে খতিয়ে দেখা হবে। সেই সঙ্গেই তিনি ফের দাবি করেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গণ্ডগোলের ঘটনা আগের থেকে অনেক কমেছে। তা আরও কমবে বলে পার্থবাবুর আশা।