অনেক টানাপড়েনের পরে নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষা মঞ্জু বন্দ্যোপাধ্যায় রিপোর্ট একটা দিলেন ঠিকই। কিন্তু ছাত্রাবাসে মারধরে মনোরোগী যুবকের মৃত্যু সংক্রান্ত মূল ঘটনার ধারপাশ দিয়েও গেলেন না তিনি। তার বদলে গাইলেন হস্টেলের সমস্যার সাতকাহন। স্বাস্থ্য ভবন সূত্রে এমনটাই জানা গেল বৃহস্পতিবার।
১৫ নভেম্বর রাতে নীলরতনের হস্টেলে চোর অপবাদ দিয়ে মানসিক প্রতিবন্ধী যুবক কোরপান শাহকে পিটিয়ে মারা হয়। সেই ঘটনা নিয়ে ব্যাপক তোলপাড়ের ১১ দিন পরে, বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য ভবনে একটি রিপোর্ট পেশ করেছেন কলেজের অধ্যক্ষা মঞ্জুদেবী। স্বাস্থ্য ভবন সূত্রের খবর, গণপিটুনিতে কারা যুক্ত ছিল, অধ্যক্ষার রিপোর্টে তাদের সম্পর্কে একটি বাক্যও খরচ করা হয়নি। হস্টেলের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় কী কী গলদ রয়েছে, কেন হস্টেলে চুরি হচ্ছে, নিরাপত্তা ব্যবস্থা কী ভাবে ঢেলে সাজা দরকার, কী ভাবে বহিরাগতদের আনাগোনা ঠেকানো যায় ইত্যাদি বিষয়ে হরেক সুপারিশ রয়েছে অধ্যক্ষার রিপোর্টে। প্রথমে স্বাস্থ্য (শিক্ষা) অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে রিপোর্টটি জমা পড়ে। সুশান্তবাবু পত্রপাঠ সেটি পাঠিয়ে দেন স্বাস্থ্যসচিবের কাছে।
অধ্যক্ষার রিপোর্টে মূল ঘটনা নিয়ে উচ্চবাচ্য নেই কেন?
এই প্রশ্নের সরাসরি জবাব মিলছে না। তবে ঘটনা পরম্পরা বলছে, নীলরতনে ওই হত্যাকাণ্ডে কোনও নির্দোষ ডাক্তারি ছাত্রকে যাতে হেনস্থা করা না-হয়, স্বাস্থ্য (শিক্ষা) অধিকর্তার কাছে চিঠি পাঠিয়ে সেই অনুরোধ করেছিল তৃণমূল ছাত্র পরিষদ (টিএমসিপি)। সেই চিঠির প্রতিলিপি পাঠানো হয়েছিল নীলরতনের অধ্যক্ষার কাছেও। হবু চিকিৎসকদের কারও গায়ে যাতে হাত না-পড়ে, তার জন্য সক্রিয় হয়েছিল তৃণমূলের শিক্ষা সেলও। তাই হস্টেলের চারতলায় গণপিটুনিতে মানসিক প্রতিবন্ধী যুবকের মৃত্যুর ঘটনায় নীলরতন-কর্তৃপক্ষ কী রিপোর্ট দেবেন, তা অনেকটা জানাই ছিল। হলও তা-ই।
রিপোর্টে ঠিক কী আছে? কী বলছেন স্বাস্থ্য (শিক্ষা) অধিকর্তা?
সুশান্তবাবু বলেন, “রিপোর্টে কী আছে, আমি জানি না। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে সেটি পাঠিয়ে দিচ্ছি। তবে এর সঙ্গে কোরপান শাহের মৃত্যুর ঘটনার সরাসরি কোনও যোগ নেই। হস্টেলের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নিয়ে তদন্ত হয়েছে। মূলত সে-কথাই বলা হয়েছে রিপোর্টে।” স্বাস্থ্য ভবন সূত্রে জানা যাচ্ছে, হস্টেলের নিরাপত্তা কী ভাবে বাড়ানো যায়, তা নিয়ে কিছু সুপারিশের সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটি মন্তব্য করা হয়েছে ওই রিপোর্টে। অধ্যক্ষার রিপোর্টের ব্যাপারে স্বাস্থ্য (শিক্ষা) অধিকর্তা বিশেষ কিছু বলতে না-চাইলেও রিপোর্টটি জমা পড়ার পরেই নীলরতন কাণ্ড নিয়ে বৃহস্পতিবার লালবাজারে বৈঠকে বসেন কলকাতা পুলিশের কয়েক জন শীর্ষ কর্তা। ওই বৈঠকে ছিলেন যুগ্ম পুলিশ কমিশনার (অপরাধ) পল্লবকান্তি ঘোষ, ডেপুটি কমিশনার (ইএসডি) ধ্রুবজ্যোতি দে এবং খুনের তদন্তকারী অফিসার-সহ গোয়েন্দা বিভাগের অফিসারেরা। বৈঠকের পরে এক পুলিশকর্তা জানান, তাঁরা স্বাস্থ্য দফতরের কাছে ওই তদন্ত রিপোর্ট চাইবেন। তাঁদের আশা, ওই রিপোর্ট হাতে পেলে খুনের মামলার তদন্তে কিছুটা সুবিধে হতে পারে।
আর পুলিশি তদন্ত কী বলছে?
পুলিশি সূত্রের খবর, এনআরএস ওই হস্টেলের আবাসিকদের সম্পর্কে যে-তথ্য দিয়েছিল, তদন্তকারীরা তা ধরেই হবু চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তবে তদন্তকারীদের দাবি, অধিকাংশ আবাসিকের বক্তব্যের সঙ্গে ঘটনার পারিপার্শ্বিক তথ্যপ্রমাণ মিলছে না। গোয়েন্দাদের মতে, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত যে-সব আবাসিকের সঙ্গে কথা হয়েছে, হয় তাঁরা কিছু আড়াল করতে চাইছেন অথবা তদন্তকারীদের ভুল পথে চালিত করতে চাইছেন। এক তদন্তকারী অফিসার এ দিন বলেন, “আমরা সাধারণত অন্যান্য অপরাধের ক্ষেত্রে যে-ভাবে জেরা করে থাকি, তার থেকে কিছুটা পৃথক কায়দায় নীলরতনের হস্টেলের আবাসিকদের জিজ্ঞাসাবাদ করছি। তা সত্ত্বেও হস্টেলের আবাসিকেরা আমাদের সঙ্গে সে-ভাবে সহযোগিতা করছেন না।” নীলরতন-কর্তৃপক্ষের কাছে ফের ওই সব আবাসিকের ছবি চাওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
এই অবস্থায় কোরপানের মৃত্যুর তদন্ত দ্রুত শেষ করতে হস্টেলের আবাসিকদের মোবাইল ফোনের অবস্থানের উপরেই জোর দেওয়া হচ্ছে বলে লালবাজার সূত্রের খবর। গোয়েন্দারা জেনেছেন, বেশ কয়েক জন হবু চিকিৎসকের মোবাইল থেকে ১৬ নভেম্বর ভোরে এবং তার পরে অস্বাভাবিক হারে ফোন করা হয়েছিল। ওই সব আবাসিকের অনেকেই এখন হস্টেলে নেই।