রাজ্যে লগ্নি টানতে অমিতের অস্ত্র সেই টাটা

রতন টাটাকে বেনজির আক্রমণ করা রাজ্য সরকার এখন আঁকড়ে ধরেছে সেই টাটাকেই। সোমবার টাটা গোষ্ঠীর শিল্প সংস্থাগুলির কর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। মঙ্গলবার রতন টাটার মন্তব্যের একটা টুকরোকে হাতিয়ার করে মুম্বইয়ে ‘বেঙ্গল লিডস’-এর প্রচার করেছে হিডকো ও শিল্পোন্নয়ন নিগম। আর শুক্রবার টাটা গোষ্ঠীর বিনিয়োগের নজির টেনেই রাজধানীতে রাজ্যের শিল্প-ভাবমূর্তি উদ্ধারের চেষ্টায় নামলেন শিল্প তথা অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০১৪ ০৩:১৬
Share:

রতন টাটাকে বেনজির আক্রমণ করা রাজ্য সরকার এখন আঁকড়ে ধরেছে সেই টাটাকেই।

Advertisement

সোমবার টাটা গোষ্ঠীর শিল্প সংস্থাগুলির কর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। মঙ্গলবার রতন টাটার মন্তব্যের একটা টুকরোকে হাতিয়ার করে মুম্বইয়ে ‘বেঙ্গল লিডস’-এর প্রচার করেছে হিডকো ও শিল্পোন্নয়ন নিগম। আর শুক্রবার টাটা গোষ্ঠীর বিনিয়োগের নজির টেনেই রাজধানীতে রাজ্যের শিল্প-ভাবমূর্তি উদ্ধারের চেষ্টায় নামলেন শিল্প তথা অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র।

গত অগস্ট মাসে বণিকসভার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসে রাজ্যের শিল্পায়ন নিয়ে কটাক্ষ করেছিলেন টাটা গোষ্ঠীর চেয়ারম্যান এমেরিটাস রতন টাটা। বলেছিলেন, দমদম বিমানবন্দর থেকে রাজারহাটের ভিতর দিয়ে বাইপাসের ধারের পাঁচতারা হোটেল পর্যন্ত আসতে কোনও শিল্প নজরে পড়েনি তাঁর। উন্নয়নের ছবিটা একটা গ্রামীণ এলাকার মতোই মনে হয়েছে। এর জবাব অমিত মিত্র দিয়েছিলেন ‘রতন টাটার মতিভ্রম হয়েছে’ এই মন্তব্য করে।

Advertisement

এহেন অমিতবাবুই আজ ‘বেঙ্গল লিডস’-এর আগে রাজধানীর শিল্পপতিদের রাজ্যে আমন্ত্রণ জানাতে গিয়ে দাবি করলেন, পশ্চিমবঙ্গে ব্যবসা করা টাটা গোষ্ঠীর বিভিন্ন সংস্থা তাদের ব্যবসা আরও বাড়ানোর কথা ভাবছে।

কথাটা উঠেছিল গত জুনে নর্থব্রুক চটকলের সিইও এইচ কে মাহেশ্বরীর খুনের প্রসঙ্গে। সিন্ডিকেটের দাপট থেকে শুরু করে ইউনিয়নের দাদাগিরি এখনও যে গুটিকয় শিল্প সংস্থা রাজ্যে টিকে রয়েছে, তাদেরও আস্থা কমছে এ সবের জেরে। আজ অমিতবাবুকে প্রশ্ন করা হয়, “আপনি কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারেন যে, আপনার রাজ্যে আর কোনও সংস্থার ম্যানেজার এ ভাবে গণপিটুনিতে মারা যাওয়ার ভয় পান না?”

আস্থার অভাবের অভিযোগ খারিজ করতে গিয়ে অমিতবাবুর যুক্তি, পশ্চিমবঙ্গে এখন একটিও শ্রমদিবস নষ্ট হয় না। শ্রমিক অসন্তোষ, তার জেরে গণ্ডগোল এ সব ইতিহাস। এই দাবির পক্ষে উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, “পশ্চিমবঙ্গে টাটা হিটাচি লগ্নি করছে। তারা অনুসারী শিল্পের জন্য তিনটি জাপানি সংস্থাকে নিয়ে এসেছে। সংস্থার ম্যানেজমেন্ট স্বচ্ছন্দ না হলে এটা হয় না। টাটা মেটালিক্স আরও ১৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে। রাজারহাটে ৪০ একর জমিতে টিসিএস-এর নতুন প্রকল্পে ২০ হাজার কর্মসংস্থান হবে।”

শিল্প মহলের মতে, টাটা গোষ্ঠী যে হেতু দেশের অন্যতম সম্মাননীয় শিল্প সংস্থা, তাই তাদের আস্থা যে রাজ্যের পক্ষে বড় বিজ্ঞাপন হতে পারে সেটা বুঝেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। বস্তুত, ন্যানো কারাখানাকে রাজ্যে আনার পিছনে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের এই যুক্তিই ছিল। টাটাদের দেখাদেখি আরও অনেক সংস্থা যে রাজ্যে লগ্নি করতে আগ্রহী হবে, সেটা বুঝেছিলেন তিনি। কিন্তু সে দিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জঙ্গি আন্দোলনের জেরে সিঙ্গুর থেকে বিদায় নিতে হয় টাটাদের। যার জেরে রাজ্যের শিল্প-ভাবমূর্তি বড় মাপের ধাক্কা খায়।

ভাগ্যের পরিহাস এটাই যে, ক্ষমতায় আসার সাড়ে তিন বছরের মাথায় লগ্নি টানার চেষ্টায় রতন টাটার কটাক্ষের একটা অংশকেই এখন ব্যবহার করতে হচ্ছে রাজ্যকে। গত মঙ্গলবার মুম্বইয়ের ‘রোড শো’-এ শিল্পপতিদের সামনে রাজারহাটের উন্নয়নের খতিয়ান দিতে গিয়ে হিডকোর চেয়ারম্যান দেবাশিস সেন যে পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন দিয়েছেন, তাতে এক ইংরাজি দৈনিকের কাটিং ব্যবহার করে তুলে ধরা হয়েছে গত অগস্টে রতন টাটার করা মন্তব্য: “বিমানবন্দর থেকে শহরে ঢোকার পথে বিভিন্ন নির্মীয়মাণ আবাসনের পরিপ্রেক্ষিতে রাজারহাটের পরিবর্তন অবিশ্বাস্য।” কিন্তু ঘটনা হল, সে দিন এখানেই থামেননি টাটা। এর পরেই কটাক্ষ করে তুলেছিলেন শিল্পায়নের ছবি চোখে না-পড়ার প্রসঙ্গ। যার জেরে টাটার ‘মতিভ্রম’ দেখেছিলেন অমিতবাবু। পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম বলেছিলেন, ‘হয়তো ওঁর মাথা খারাপ হয়েছে’।

কিন্তু বিধানসভা ভোটের দেড় বছর আগে রাজ্যে যখন ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছে বিজেপি, সরকারের ভাবমূর্তি যখন তলানিতে, তখন একটা মরিয়া চেষ্টা হিসেবেই শাসক দল শিল্পপতিদের বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করছে বলে অনেকের মত। আর সেই কাজে তাদের ‘ভরসা’ টাটা গোষ্ঠীই।

সোমবার রাজ্যে ব্যবসা করা টাটা গোষ্ঠীর সংস্থাগুলির কর্তাদের নবান্নে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। প্রায় ঘণ্টা দেড়েকের বৈঠকে তিনি জানতে চান, তাঁদের কোনও অসুবিধা হচ্ছে কি না। এমনকী সমস্যার কথা উঠলে, জলদি তার সমাধানের জন্য তখনই ফোনে কথা বলেন সংশ্লিষ্ট দফতরের কর্তাদের সঙ্গে। যে তৎপরতাকে ভাবমূর্তি উদ্ধারের চেষ্টার পাশাপাশি সুপ্রিম কোর্টে সিঙ্গুর মামলার রায়ের ঠিক আগে টাটাদের প্রতি এক ধরনের বার্তা হিসেবেও দেখা হচ্ছে।

কিন্তু টাটাদের জয়গানে তৃণমূলের গায়ে এঁটে থাকা শিল্পবিরোধী তকমা কিছুটা আলগা হবে কি না সেটা পরের কথা, রাজ্যের শিল্পচিত্রের কিছু পরিবর্তন হবে কি? সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, জমি নীতি বদল বা সিন্ডিকেটের দাপট বন্ধের মতো কাজগুলি না-করলে আখেরে কাজের কাজ কিছুই হবে না।

যার ইঙ্গিত দিয়ে অমিতবাবুর সম্মেলনের পরে দক্ষিণ কোরিয়ার ট্রেড-ইনভেস্টমেন্ট প্রোমোশন এজেন্সি ‘কোটরা’-র ভারত ও দক্ষিণ এশিয়ার চিফ ডিরেক্টর জেনারেল ডং সেওক চোই বলে গেলেন, “আমরা পশ্চিমবঙ্গে লগ্নির সম্ভাবনা খতিয়ে দেখছি। তবে লগ্নির গন্তব্য হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ সম্পর্কে ধারণা খুব একটা ভাল নয়।” সঙ্গে অবশ্য সৌজন্য হিসেবে জুড়লেন, “নতুন শিল্পমন্ত্রী ভাবমূর্তি পাল্টানোর জন্য চেষ্টা করছেন বলেই মনে হচ্ছে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন