সিবিআইয়ের লগ্নি-তদন্ত

রেড ওয়াইন কার, খুঁজতেই বড় মাথায় টান

ছুটছিল তো স্কচের ফোয়ারা! তার মাঝে হঠাৎ আড়াই পাত্র রেড ওয়াইন? বাইপাসের পাঁচতারায় মন্ত্রীমশাইয়ের মজলিশের খানাপিনার খতিয়ান ঘাঁটতে গিয়ে সিবিআইয়ের খটকা লেগেছিল। সেই ওয়াইনপ্রেমীর খোঁজ করতে গিয়েই তাদের সামনে খুলে গিয়েছে সম্পূর্ণ অজানা একটা দরজা। রেড ওয়াইনের সূত্রে মন্ত্রীর চক্রে জুড়ে গিয়েছেন আর এক অর্থ লগ্নি সংস্থার কণর্র্ধার, যিনি কিনা কেলেঙ্কারির বহরের নিরিখে সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেনকে চ্যালেঞ্জ ছুড়তে পারেন বলে তদন্তকারীরা মনে করছেন!

Advertisement

শুভাশিস ঘটক

শেষ আপডেট: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৩:৫৬
Share:

ছুটছিল তো স্কচের ফোয়ারা! তার মাঝে হঠাৎ আড়াই পাত্র রেড ওয়াইন?

Advertisement

বাইপাসের পাঁচতারায় মন্ত্রীমশাইয়ের মজলিশের খানাপিনার খতিয়ান ঘাঁটতে গিয়ে সিবিআইয়ের খটকা লেগেছিল। সেই ওয়াইনপ্রেমীর খোঁজ করতে গিয়েই তাদের সামনে খুলে গিয়েছে সম্পূর্ণ অজানা একটা দরজা। রেড ওয়াইনের সূত্রে মন্ত্রীর চক্রে জুড়ে গিয়েছেন আর এক অর্থ লগ্নি সংস্থার কর্ণধার যিনি কিনা কেলেঙ্কারির বহরের নিরিখে সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেনকে চ্যালেঞ্জ ছুড়তে পারেন বলে তদন্তকারীরা মনে করছেন!

রাজ্যের প্রভাবশালী মন্ত্রীটির সারদা-সংস্রবের কথা সিবিআই ইতিমধ্যে জানতে পেরেছে। এখন গোয়েন্দাদের দাবি: অন্য লগ্নি সংস্থার মালিকটিও ব্যবসার ঝামেলা মেটাতে মন্ত্রীমশাইয়ের দ্বারস্থ হয়েছিলেন, আর তাঁর কাজ হাসিলের বিনিময়ে মন্ত্রীও আর্থিক ফায়দা লুটেছেন। সিবিআই-সূত্রের খবর: প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ওই লগ্নি সংস্থার মালিকও এটা স্বীকার করে নিয়েছেন। তাঁর সংস্থার কারবার এবং মন্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)-ও তদন্ত শুরু করেছে।

Advertisement

কেলেঙ্কারির এই নতুন ‘মাথা’র হদিস মিলল ঠিক কী ভাবে?

কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরো সূত্রে জানা যাচ্ছে, উল্লিখিত মন্ত্রী ২০১২-র মার্চ-এপ্রিলে ইএম বাইপাস লাগোয়া পাঁচতারা হোটেলটিতে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। কখনও দুপুরে, কখনও সন্ধ্যায় সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে তিনি জমাতেন পানভোজনের আসর, যেখানে নামীদামি বিদেশি মদের স্রোত বইত। ‘মেনু’তে থাকত মূলত স্কচ, সঙ্গে দেশি-বিদেশি খাবার-দাবার। হোটেলের নথি ঘেঁটে তথ্য-তালাশ করতে গিয়ে সিবিআই অফিসারদের নজর পড়ে এমন তিনটি আড্ডার অর্ডার-তালিকার দিকে। সেগুলোয় ঢালাও স্কচের হুকুম তো ছিলই, পাশাপাশি আড়াই পাত্র করে রেড ওয়াইনও গিয়েছে!

এখানেই সন্দেহ জাগে তদন্তকারীদের। কেন?

সিবিআই সূত্রের ব্যাখ্যা: অন্য সব আসরে পানীয় হিসেবে ছিল শুধু স্কচ। শুধু ওই তিনটিতে রেড ওয়াইনও ছিল, এবং ঠিক একই পরিমাণে। অর্থাৎ, সেটা নির্দিষ্ট এক জনের জন্যই বরাদ্দ হয়েছে, যিনি মন্ত্রীমশাইয়ের ওই বিশেষ তিনটি মজলিশে হাজির ছিলেন।

স্বভাবতই তদন্তকারীদের মনে প্রশ্ন ওঠে, কে সেই বিশেষ ব্যক্তি? সিবিআই সূত্রের খবর: খোঁঁজ করতে গিয়ে প্রথমে এক মহিলার কথা ভাবা হয়েছিল। কারণ, সুরাপায়ী অনেক মেয়ে স্কচ-হুইস্কির তুলনায় রেড ওয়াইন বেশি পছন্দ করেন। উপরন্তু মন্ত্রীমশাইয়ের মহিলা-সংস্রব নানা মহলে চর্চার খোরাক। “মহিলাদের সঙ্গে ওঁর ঘনিষ্ঠতা নিয়ে এমনিতেই নানা জল্পনা। এক জনের সঙ্গে ওঁর সম্পর্ক ঘিরে তো বিস্তর জলঘোলাও হয়েছে।”

পাঁচতারার আসরে সেই মহিলাই এসেছিলেন কি না, সিবিআই তা যাচাই করতে নামে। হোটেলের সিসিটিভি’তে নির্দিষ্ট দিনগুলোর ফুটেজ পরীক্ষা করা হয়। তাতেই ঘুরে যায় তদন্তের মোড়! কী রকম?

সিবিআই সূত্রের দাবি: সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, হোটেলে মন্ত্রীমশাই থাকাকালীন সেখানে ঢুকছেন ওই লগ্নি সংস্থার মালিক, যাঁর সঙ্গে সরকারের শীর্ষ স্তরের দহরম-মহরমের খবর ইতিমধ্যে নানা ভাবে, নানা দিক দিয়ে উঠে এসেছে। ওখানেও ওঁর উপস্থিতির প্রমাণ পেয়ে গোয়েন্দারা চমকে ওঠেন। পরে তাঁর ছবি দেখিয়ে হোটেল-কর্মীদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তাঁদের মুখে জানা যায়, উল্লিখিত ব্যক্তি মন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেই হোটেলে এসেছিলেন, আর তাঁর জন্যই রেড ওয়াইন গিয়েছিল। ঠিক আড়াই পাত্র।

উনি মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে হোটেলের আড্ডায় গেলেন কেন? অফিস বা বাড়ি যেতে পারতেন তো?

ব্যুরো সূত্রের খবর: মন্ত্রীর এক ঘনিষ্ঠ সঙ্গী প্রথমে তদন্তকারীদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি জানান, ওই ব্যক্তির একটি বিদেশি গাড়ি রয়েছে, তার রেজিস্ট্রেশন সংক্রান্ত সমস্যা মেটাতেই মন্ত্রীর কাছে দরবার। কিন্তু নিছক এই কারণে হোটেলে গিয়ে তিন-তিন বার দেখা করতে হবে এ হেন যুক্তি তদন্তকারীরা মেনে নিতে পারেননি। মন্ত্রী-ঘনিষ্ঠকে খুঁটিয়ে জেরা করেন তাঁরা। মজলিশে হাজির থাকা অন্য কয়েক জনকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

সিবিআই সূত্রের দাবি: গাড়ির সমস্যা নয়, বরং লগ্নি-কারবারের কিছু সমস্যা সুরাহার আর্জি নিয়েই ওই ব্যক্তি প্রভাবশালী মন্ত্রীর সঙ্গে তিন বার হোটেলে দেখা করেন। ওঁর মুশকিল আসান করে মন্ত্রীও সংস্থাটি থেকে টাকা নিয়েছেন বলে কেন্দ্রীয় তদন্তকারীদের অভিযোগ।

ইডি এবং সিবিআই সূত্রের দাবি: ওই অর্থলগ্নি সংস্থাটির টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। সেই সূত্রে উঠে আসছে এক বাংলাদেশি বস্ত্র ব্যবসায়ীর নামও, পূর্ব কলকাতায় যাঁর অফিস রয়েছে। “তার চেয়েও বড় কথা, ওঁর সঙ্গে মন্ত্রীর যথেষ্ট মাখামাখি।” বলছেন এক সিবিআই অফিসার। পারস্পরিক সম্পর্কের এই প্রেক্ষাপটে কেন্দ্রীয় তদন্তকারীদের সন্দেহ, লগ্নি সংস্থাটির অর্থ পাচারের পিছনে মন্ত্রীর ভূমিকা থাকলেও থাকতে পারে।

এ বিষয়টি নিয়েও ইডি-সিবিআই তদন্ত শুরু করেছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement