শিক্ষিকাকে চড়ের পরে বিশ্ববিদ্যালয়েও হামলা

একটা গোলযোগ মিটতে না মিটতেই আর একটা। শিক্ষাঙ্গনে নৈরাজ্যের ঘটনায় বারবার জড়িয়ে যাচ্ছে রাজ্যের শাসকদল ও তার অনুগামী সংগঠনের লোকজনের নাম। বর্ধমানের বিবেকানন্দ কলেজে শিক্ষিকাকে চড় মারার ঘটনার নিষ্পত্তি এখনও হয়নি। এ দিনও শিক্ষকেরা এক ঘণ্টা ক্লাস বয়কট করে প্রতিবাদ জানান। এরই মধ্যে শুক্রবার বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান বিভাগে সচিবের দফতরে হামলার অভিযোগ উঠল তৃণমূল সমর্থক শিক্ষাকর্মীদের বিরুদ্ধে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

বর্ধমান শেষ আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০১৪ ০৩:২০
Share:

বর্ধমানের বিবেকানন্দ কলেজের গেটে শিক্ষকদের ধর্না। —নিজস্ব চিত্র।

একটা গোলযোগ মিটতে না মিটতেই আর একটা। শিক্ষাঙ্গনে নৈরাজ্যের ঘটনায় বারবার জড়িয়ে যাচ্ছে রাজ্যের শাসকদল ও তার অনুগামী সংগঠনের লোকজনের নাম।

Advertisement

বর্ধমানের বিবেকানন্দ কলেজে শিক্ষিকাকে চড় মারার ঘটনার নিষ্পত্তি এখনও হয়নি। এ দিনও শিক্ষকেরা এক ঘণ্টা ক্লাস বয়কট করে প্রতিবাদ জানান। এরই মধ্যে শুক্রবার বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান বিভাগে সচিবের দফতরে হামলার অভিযোগ উঠল তৃণমূল সমর্থক শিক্ষাকর্মীদের বিরুদ্ধে।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রের খবর, তিন কর্মীর বদলি নিয়ে এ দিন বিকেলে উপাচার্য স্মৃতিকুমার সরকারের সঙ্গে তর্ক হয় বিজ্ঞান বিভাগের সচিব শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদারের। তাঁর অভিযোগ, “দফতরে ফিরতেই তৃণমূল প্রভাবিত কর্মচারী ইউনিয়নের কিছু লোক সীতারাম মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ঢুকে মারধরের চেষ্টা করে, ভাঙচুর করে। দফতরের কর্মীরা না বাঁচালে বড়সড় বিপদ ঘটে যেত।”

Advertisement

বছর দুয়েক আগেও শুভব্রতবাবু এক বার তৃণমূলের লোকজনের হাতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তাঁর অভিযোগ, “এ দিন দফতরে ফিরতেই ফোন করে সীতারামবাবু বলেন, আমি উপাচার্যের দফতরে ঢুকে অসভ্যতা করেছি। আমি বলি, যদি কোনও অন্যায় করে থাকি, তা উপাচার্য বুঝবেন। আপনি নাক গলাচ্ছেন কেন? এটা বলার পরেই উনি বেশ কিছু সমাজবিরোধীকে নিয়ে দফতরে এসে হামলা চালান।”

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাবন্ধু সমিতির সাধারণ সম্পাদক সীতারামবাবু অবশ্য দাবি করেন, “উনি মিথ্যা বলেছেন। আমি ওঁকে ফোন করিনি। আর, অত লোক নিয়ে ওঁর দফতরে গেলে উনি কি আস্ত থাকতেন?” উপাচার্যের ঘরে শুভব্রতবাবুকে কথা বলতে নিয়ে যান রেজিস্ট্রার শ্রীপতি মুখোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, “উনি উপাচার্যকে কিছু খারাপ কথা বলেছেন ঠিকই। পরে খবর পাই, গোলমাল হচ্ছে। তা শুনে, আমি নিজেই সীতারামবাবুকে ফোন করে বলি, ‘দেখবেন, কোন মতেই যেন ওঁকে মারধর করা না হয়।’ তার পরে উনি আমায় কিছু জানাননি।”

শুভব্রতবাবুর অভিযোগ, হামলা হতেই তিনি উপাচার্যকে এসএমএসে ঘটনার কথা জানান। কিন্তু তিনি উত্তর দেননি। পরে পুলিশ এলে তাদের কাছে অভিযোগ দেন তিনি। তাঁর দাবি, “শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কেও বিষয়টি জানিয়েছি।” বারবার ফোন করা হলেও উপাচার্য ধরেননি, একাধিক বার কেটেও দিয়েছেন। তবে রাতে পার্থবাবু বলেন, “শিক্ষাঙ্গনে ভাঙচুর, তা সে যে-ই করুক, সমর্থনযোগ্য নয়। আমি উপাচার্যকে বলছি, অবিলম্বে কী ঘটেছে, কারা জড়িত তা জানাতে। এই ঘটনায় যে-ই জড়িত থাক, তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বিবেকানন্দ কলেজের অভিযুক্ত ছাত্রের বিরুদ্ধেও। অধ্যক্ষ শিবপ্রসাদ রুদ্র জানান, বিকাশ দাস নামে প্রথম বর্ষের ওই ছাত্রটিকে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে টিচার্স কাউন্সিল। বুধবার এক সহপাঠিনীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখে আপত্তি করায় বুধবার সে দর্শন বিভাগের প্রধান সাত্বকী পোদ্দারকে কলেজের গেটে চড় মারে বলে অভিযোগ। কিন্তু ছাত্রটির পাশে দাঁড়ায় টিএমসিপি সমর্থিত ছাত্র সংসদ। শিক্ষিকা আক্রান্ত হননি, বরং তিনিই ছাত্রটিকে মেরেছেন বলে তারা অধ্যক্ষের কাছে অভিযোগ করে।

ঘটনার প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার ক্লাস নেননি কলেজের শিক্ষকেরা। এ দিন ক্লাস হলেও দুপুর ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত শিক্ষকেরা বিক্ষোভ দেখান। কলেজের শিক্ষিকা মিনা হাটি বলেন, “৩৩ বছর ধরে পড়াচ্ছি। ছাত্রের হাতে মার খেতে হচ্ছে, এমন দুর্ভাগ্য হয়নি।” অধ্যক্ষ বলেন, “ছাত্রটিকে শুধু কলেজ থেকে বহিষ্কারই করা হবে না, যাতে সে কোনও কলেজেই ভর্তি হতে না পারে, তার ব্যবস্থাও করা হবে। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে সোমবার কলেজ পরিচালন সমিতির বৈঠকে। যত দিন ওই ছাত্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া না হয়, শিক্ষকেরা কালো ব্যাজ পরে ক্লাস নেবেন।”

রাজ্য মহিলা কমিশনের সদস্য শিখা আদিত্য এ দিন কলেজে যান। তৃণমূলের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সংগঠন ‘ওয়েবকুপা’ও সাত সদস্যের প্রতিনিধিদল পাঠায়। শিক্ষকদের সঙ্গে বৈঠকের পরে সংগঠনের বর্ধমান জেলা কার্যকরী সভাপতি নিরঞ্জন মণ্ডল ও সাধারণ সম্পাদক শ্রীধর বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “টিচার্স কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত সমর্থন করছি। জেলাশাসক, পুলিশ সুপার ও শিক্ষামন্ত্রীর কাছে আমরা প্রতিকার দাবি করব।”

কলেজের টিএমসিপি নেতারা অবশ্য এখনও অভিযুক্ত ছাত্রটিকে আড়াল করার চেষ্টা করে চলেছেন। ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ হাজরার দাবি, “শিক্ষিকাকে যে চড় মারা হয়েছে, তার প্রত্যক্ষদর্শী নেই। বরং উনি যে ছাত্রটিকে আঁচড়ে-কামড়ে দিয়েছেন, তার বহু প্রত্যক্ষদর্শী হাজির রয়েছে।” টিচার্স কাউন্সিলের সম্পাদক অনিমেষ দেবনাথের প্রতিক্রিয়া, “ছাত্র সংসদের নেতা হওয়ার উপযুক্ত মানই ওদের নেই। উপরমহলের মদতে ওরা কুকর্ম সমর্থন করার সাহস পাচ্ছে।” টিএমসিপি-র শহর কমিটির সভাপতি রাসবিহারী হালদার অবশ্য বলেন, “যদি ছাত্রটি দোষী হয়ে থাকে, ব্যবস্থা নেব।” শিক্ষক অসীম মুখোপাধ্যায় বলেন, “এই ঘটনায় যেন রাজনীতি না মেশে, তা দেখতে হবে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন