শীতের সাজ। রবিবার কলকাতার ময়দানে। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক
মরসুমের শুরুতেই কাঁপন ধরিয়ে শীত এ বার চমকে দিয়েছিল। কিন্তু দফায় দফায় নিম্নচাপ-ঘূর্ণাবর্তের হামলায় তার মহিমা বারে বারে হোঁচট খেয়েছে। তাই, মকর সংক্রান্তির দিন তিনেক বাকি থাকতেই হিম-হাওয়া যে-খেল্ দেখাতে শুরু করেছে, গঙ্গাসাগরে স্নানের দিন তা থাকবে কি না, সংশয় আছে খাস আবহাওয়া দফতরেরই।
তবে ইংরেজি নতুন বছরের শুরুতে যে-শীত কুণ্ঠিত হয়ে পড়েছিল, দক্ষিণবঙ্গ জুড়ে কনকনে হাওয়া বইতে শুরু করায় আপাতত তার কোমরে কিছু জোর ফিরেছে। রাতের তাপমাত্রা নেমে এসেছে স্বাভাবিকের নীচে! রবিবার কলকাতায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা (ভোরে) ছিল ১২.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস, স্বাভাবিকের থেকে এক ডিগ্রি কম। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ১৯.৫ ডিগ্রি, স্বাভাবিকের থেকে সাত ডিগ্রি কম। সারা দিনই বয়েছে উত্তরের ঠান্ডা হাওয়া। রোদ গায়ে লাগেনি। এ-সব দেখে শীতপ্রেমিকদের অনেকেই আশা করছেন, নববর্ষে ঝিমিয়ে থাকা ঠান্ডা অবশেষে লম্বা দাপুটে ইনিংস খেলতে চলেছে। সেই জবরদস্ত ইনিংস অন্তত পৌষ সংক্রান্তি পর্যন্ত চলবে ভেবে পুলকিত হয়ে উঠছেন অনেকে।
কিন্তু তেমন কোনও আশা দিচ্ছেন না আবহবিদেরা। এ বার শীতের ব্যাটিং-ফর্মের লাগাতার ওঠাপড়া তাঁদেরও নিশ্চিত পূর্বাভাস দিতে দিচ্ছে না। তাঁরা বলছেন, এমন ঠান্ডা বড়জোর দিন দুয়েক থাকবে। তার পরেই সামান্য বাড়বে তাপমাত্রা। একেবারে নিরাশ না-করে আলিপুর আবহাওয়া দফতরের অধিকর্তা গোকুলচন্দ্র দেবনাথ বলছেন, “মকর সংক্রান্তিতে শীত মিলবে। কিন্তু তাতে এত কনকনে ভাব থাকবে না।”
না-থাকুক, এ দিন শীতের অযাচিত দান দু’হাত ভরে নিয়েছেন অনুরাগীরা। ছুটির দিনে ময়দান, চিড়িয়াখানা, বনভোজনের মজা শীতের সঙ্গতে দ্বিগুণ হয়েছে। কনকনে উত্তুরে হাওয়ায় মিলেছে আগাম মকর সংক্রান্তির আমেজ। সকাল থেকেই ভারী সোয়েটার, জ্যাকেট চাপিয়ে রাস্তায় বেরিয়েছেন মানুষজন। ভরদুপুরেও গাড়ি ছুটেছে কাচ তুলে। বিকেল গড়াতেই পারদ-পতন শুরু হয়। হাওয়া অফিস সূত্রের খবর, বিকেল সাড়ে ৫টা নাগাদ কলকাতার তাপমাত্রা ছিল ১৮ ডিগ্রি। সন্ধ্যা গড়াতেই শুরু হয় কাঁপুনি। রাস্তায় বেরোতে গিয়ে টুপি, মাফলারে কান-মাথা ঢেকেছেন মানুষজন। রাত সাড়ে ৮টায় সেটা কমে হয়ে যায় ১৫.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
বস্তুত, ভরা মরসুমে শীতের স্বাভাবিক দস্তুর এটাই। পৌষের মাঝামাঝি থেকে দক্ষিণবঙ্গে জাঁকিয়ে শীত পড়ে। বইতে থাকে উত্তুরে হাওয়া। মকর সংক্রান্তি যত এগোয়, ততই বাড়তে থাকে শীতের পরাক্রম। কিন্তু এ বার সেই স্বাভাবিকতার পরম্পরা অটুট থাকেনি। ভরা পৌষেও শীতের মেজাজ সপ্তমে চড়তে দেখা যায়নি। ইংরেজি বছরের শেষে একটি নিম্নচাপ বেশ জাঁকিয়ে বসেছিল বঙ্গোপসাগরে। তার কারিকুরিতে হোঁচট খেয়েছিল উত্তুরে হাওয়া। নিম্নচাপটি ওড়িশা-বাংলা উপকূল দিয়ে স্থলভূমিতে ঢোকার পরে বৃষ্টিও হয় কলকাতা-সহ দক্ষিণবঙ্গে।
হাওয়া অফিসের বিজ্ঞানীরা বলছেন, সেই নিম্নচাপ বিদায় নেওয়ায় শীতের পথের কাঁটা আপাতত সরেছে ঠিকই। তবে কনকনে হাওয়ার এই হুড়মুড়িয়ে হামলার কারণটা একটু আলাদা। সেটা তা হলে কী?
উত্তর ভারত থেকে একটি পশ্চিমী ঝঞ্ঝা (ভূমধ্যসাগরীয় এলাকা থেকে পাকিস্তান, আফগানিস্তান হয়ে কাশ্মীরে ঢোকা হাওয়া) পূর্ব দিকে সরে এসেছিল। তার জেরে সিকিম ও দার্জিলিঙে তুষারপাত ও বৃষ্টি হয়েছে। সেখানে তৈরি হয়েছে একটি উচ্চচাপ বলয় (ঠান্ডা ও ভারী বায়ুস্তর)। দক্ষিণবঙ্গে বইতে থাকা ঠান্ডা হাওয়ার উৎস সেই উচ্চচাপ বলয়ই, জানাচ্ছেন আলিপুর হাওয়া অফিসের অধিকর্তা।
আবহবিদদের মতে, এই উচ্চচাপ বলয়ের প্রভাবে এমন ঠান্ডা থাকবে মাত্র দিন দুয়েক। তার পরে তাপমাত্রা সামান্য বাড়বে। সেই তাপমাত্রা বৃদ্ধির রহস্য আবার লুকিয়ে রয়েছে সুদূর উত্তর-পশ্চিম ভারতে। দিল্লির মৌসম ভবনের একটি সূত্র জানাচ্ছে, আফগানিস্তান এবং সংলগ্ন এলাকার উপরে একটি পশ্চিমী ঝঞ্ঝা হাজির হয়েছে। আগামী দিন দুয়েকের মধ্যে সেটি কাশ্মীরে ঢুকবে। তার প্রভাবে মেঘলা হয়ে যাবে উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম ভারতের আকাশ। সর্বনিম্ন তাপমাত্রাও বাড়বে। পাল্লা দিয়ে কমতে থাকবে উত্তুরে হাওয়ার দাপট।
অর্থাৎ নিম্নচাপ-উচ্চচাপ-ঘূর্ণাবর্ত-পশ্চিমী ঝঞ্ঝার আবর্ত থেকে রেহাই পাচ্ছে না বলেই একটানা দাপুটে ইনিংস খেলতে পারছে না শীত। সাগরস্নানেও যে তার স্বমহিমায় হাজিরা নিয়ে সংশয় থাকছে, তারও মূলে ওই পশ্চিমী ঝঞ্ঝা-উচ্চচাপের কাঁটা। আবহবিজ্ঞানীদের ব্যাখ্যা, উত্তর-পশ্চিম ভারতে উত্তুরে হাওয়া দুর্বল হয়ে গেলে তার প্রভাব পড়বে পূর্ব ভারতেও। অথচ মকর সংক্রান্তির কনকনে ঠান্ডা মূলত জোরালো উত্তুরে হাওয়ারই অবদান। তার দাপট কমলে পৌষ সংক্রান্তিতে চেনা শীত মিলবে না বলেই মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।