রাজধানীতে সাউথ অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে বসে সকাল থেকেই চোখ ছিল টেলিভিশনের পর্দায়। সুপ্রিম কোর্টে কী হচ্ছে, কখন সারদা সংক্রান্ত মামলার শুনানি শুরু হবে, কপিল সিব্বল কি কোর্টে পৌঁছেছেন এ সবই জানার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু সারা দিনের অপেক্ষাই সার হল মুকুল রায়ের। মঙ্গলবার শেষ পর্যন্ত সারদা সংক্রান্ত মামলার শুনানি হল না। শুক্রবার বেলা ১১টায় সিবিআইয়ের সামনে হাজিরা দিতে হবে মুকুলবাবুকে। তার আগে আজ স্বস্তি পেলেন না তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক।
সারদা কেলেঙ্কারির সিবিআই তদন্তে সুপ্রিম কোর্টের নজরদারি চেয়ে আবেদন জানিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার। তৃণমূল কংগ্রেসের তরফেও একই আবেদন করা হয়েছিল। আজ দুপুরে সেই আবেদনেরই শুনানি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বিচারপতিরা সুপ্রিম কোর্টের কলেজিয়ামের বৈঠকে ব্যস্ত থাকায় শেষ পর্যন্ত শুনানি হয়নি। কবে শুনানি হবে, আজ সে সম্পর্কে কিছু জানানোও হয়নি।
সারদা কেলেঙ্কারি মামলায় সিবিআইয়ের হাতে তৃণমূলের একের পর এক বড় মাপের নেতা গ্রেফতার হওয়ার পর থেকেই শাসক দলের তরফে অভিযোগ ওঠে, কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থাটিকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে বিজেপি সরকার। তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়কে সিবিআই ডেকে পাঠানোর পরেই সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করে দেয় রাজ্যের তৃণমূল সরকার। তখনই ঠিক হয়, দল হিসেবে তৃণমূলও এই মামলায় যোগ দিয়ে তদন্তে সর্বোচ্চ আদালতের নজরদারি চাইবে। এর পরে দফায় দফায় দিল্লি এসে আইনজীবীদের সঙ্গে শলাপরামর্শের পর গত ১৯ জানুয়ারি রাজ্য সরকার ও তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক মহুয়া মৈত্র পৃথক ভাবে সর্বোচ্চ আদালতে আবেদন জানান।
পশ্চিমবঙ্গ সরকার এবং তৃণমূল চাইছিল, সুপ্রিম কোর্ট সিবিআই তদন্তে একটি নজরদারি কমিটি গড়ে দিক। তা হলে তারা যে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের অভিযোগ তুলছে, তা সত্যি বলে দাবি করতে পারবে তৃণমূল। সে ক্ষেত্রে সিবিআইকে নিয়মিত ভাবে তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে রিপোর্ট পেশ করতে হবে আদালতে। রাজ্য নিরপেক্ষ তদন্ত চায় বলেও দাবি করতে পারবে।
কিন্তু আজ শুনানি না হওয়ায় বিলক্ষণ হতাশ তৃণমূল শিবির। যাঁর উদ্যোগে সারদায় সিবিআই তদন্ত চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে জনস্বার্থ মামলা হয়েছিল, সেই কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নান এ দিন মুকুল রায়ের নাম না করে কটাক্ষ করেন, “যাঁরা ভেবেছিলেন সিবিআইয়ের কাছে যাবেন না, তাঁদের যেতেই হবে!” বিজেপি নেতা তথাগত রায় বলেন, “মুকুল রায়কে সমবেদনা জানাতে হবে। কিন্তু বাস্তব হল, তাঁকে সিবিআইয়ের কাছে যেতেই হচ্ছে!’’ সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তীরও কটাক্ষ, “মুকুলবাবুকে সিবিআইয়ের প্রশ্নের মুখোমুখি হতেই হবে। কিন্তু তাঁর উত্তর দেওয়ার কিছু নেই!”
যাঁকে নিয়ে এত কথা-কটাক্ষ, মঙ্গলবার শুনানি না হওয়ায় সেই মুকুলবাবু ঠিক করেন, বুধবারই তিনি কলকাতায় ফিরে যাবেন। তিনি দিল্লি এসেছিলেন সরস্বতী পুজোর দিন। সুপ্রিম কোর্টে মামলার সঙ্গে তাঁর দিল্লিবাসের যোগ অস্বীকার করে মুকুল এ দিন বলেন, “আমাদের তৃণমূল কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক মামলা করেছেন। তার জন্য আমার দিল্লিতে বা আদালতে উপস্থিত থাকা বাধ্যতামূলক নয়। আমি রাজনৈতিক কাজে দিল্লিতে ছিলাম। কাজ শেষ হয়ে গিয়েছে বলেই ফিরে যাচ্ছি।” শুক্রবার যে তিনি সিবিআই দফতরে যাচ্ছেন, তা নিয়েও কোনও অস্পষ্টতা নেই বলে জানিয়ে দেন মুকুল। তিনি বলেন, “সিবিআই আমাকে ডেকেছে। দেখা করব। তদন্তে সাহায্য করব।” রাজনৈতিক শিবিরের একাংশের জল্পনা, সিবিআই নিয়ে বিজেপির বিরুদ্ধে তৃণমূল সরব হলেও মুকুল নিজে কিন্তু কেন্দ্রের শাসক দলের নেতাদের সঙ্গে দেখা করে গোয়েন্দাদের হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা করছেন। যদিও মুকুল বলেন, “আমি অমিত শাহের সঙ্গে দেখা করেছি বলে রটানো হচ্ছে। আমি কেন দেখা করব? এই ভাবে গোপনে কিছু হয় না। আবারও বলছি, আমি সব রকম ভাবেই তদন্তে সহযোগিতা করব।”
মুকুল সিবিআইয়ের মুখোমুখি হওয়ার আগেই যাতে সুপ্রিম কোর্টে এই মামলার শুনানি হয়, সে জন্য সব চেষ্টাই চালিয়েছিল রাজ্য সরকার ও তৃণমূল। রাজ্যের তরফে আইনজীবী কপিল সিব্বল, তৃণমূলের আইনজীবী বিবেক টাঙ্খা মামলাটি জরুরি ভিত্তিতে শোনার আবেদন জানান বিচারপতি টি এস ঠাকুরের কাছে। গত বছর মে মাসে রাজ্য সরকারের আপত্তি খারিজ করে এই বিচারপতি ঠাকুর এবং বিচারপতি সি নাগাপ্পনকে নিয়ে গড়া বেঞ্চই সারদা কেলেঙ্কারিতে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেয়। কিন্তু ওই দুই বিচারপতির বেঞ্চে এখন আর শুনানি হয় না। তাই বিশেষ ভাবে শুধু এই মামলাটি শোনার জন্যই ওই বেঞ্চ গঠন করে শুনানি হবে।
ঠিক ছিল, আজ বেলা দু’টোয় শুনানি হবে। তার পর তা পৌনে তিনটে পর্যন্ত পিছিয়ে যায়। কপিল সিব্বল, বিবেক টাঙ্খা, তৃণমূলের মহুয়া মৈত্ররা সকলেই তখন এজলাসে হাজির। কেন্দ্র বা সিবিআইকে ডাকা না হলেও শুনানির খবর শুনে অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেল মনিন্দর সিংহও এজলাসে চলে আসেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে আদালতের আধিকারিকরা জানিয়ে দেন, বিচারপতিরা কলেজিয়ামের বৈঠকে ব্যস্ত থাকায় আজ শুনানি হবে না। কবে শুনানি হবে, তা নিয়েও অনিশ্চয়তা রয়েছে। কারণ এই দুই বিচারপতি ফের এক সঙ্গে মামলা শোনার সময় পেলে তবেই শুনানি হবে। সিবিআই তদন্তের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ও রাস্তায় নামার জন্য সুপ্রিম কোর্টে মুখ্যমন্ত্রী, রাজ্যের মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলাও হয়েছিল। এই বেঞ্চেই সেই মামলাটিরও শুনানি হওয়ার কথা ছিল এ দিন। সেই মামলার আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য কলকাতা থেকে দিল্লি আসেন শুনানিতে যোগ দিতে। শুনানি না হওয়ায় বিকাশবাবু বলেন, “যাঁরা তদন্ত বিঘ্নিত করার আশা দেখছিলেন, তাঁদের উদ্দেশ্য সফল হল না।”