রাজারহাট তথ্যপ্রযুক্তি

শিল্পপ্রশাসন-সিন্ডিকেটের সাঁড়াশি, দমছুট ছোটরা

কখনও ইট-বালি-চুন-সুরকি, কখনও নিয়োগ সংক্রান্ত খবরদারি চলছিলই। সিন্ডিকেটের দাপট এখন পানীয় জলেও মিশে গিয়েছে বলে অভিযোগ। রাজারহাটে অজস্র ছোট ও মাঝারি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার আক্ষেপ, সামান্য জল কেনা নিয়েও যেখানে সিন্ডিকেটের নির্দেশ আর ধমকের মুখে পড়তে হয়, সেখানে টিকব কী করে? সবার কপাল তো উইপ্রো-র মতো নয়!

Advertisement

গার্গী গুহঠাকুরতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ অক্টোবর ২০১৪ ০৩:০১
Share:

কখনও ইট-বালি-চুন-সুরকি, কখনও নিয়োগ সংক্রান্ত খবরদারি চলছিলই। সিন্ডিকেটের দাপট এখন পানীয় জলেও মিশে গিয়েছে বলে অভিযোগ। রাজারহাটে অজস্র ছোট ও মাঝারি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার আক্ষেপ, সামান্য জল কেনা নিয়েও যেখানে সিন্ডিকেটের নির্দেশ আর ধমকের মুখে পড়তে হয়, সেখানে টিকব কী করে? সবার কপাল তো উইপ্রো-র মতো নয়!

Advertisement

প্রশাসনিক গড়িমসি, বিশেষ আর্থিক অঞ্চল (সেজ)-এর সুবিধা না পাওয়া ইত্যাদির জেরে রাজারহাটে প্রকল্পের কাজ শুরু করতে পারেনি উইপ্রো। পড়তে হয়েছিল জরিমানার মুখে। সম্প্রতি সেই জরিমানা মকুব করেছে রাজ্য। কিন্তু এক দিকে সিন্ডিকেটের জুলুম আর অন্য দিকে প্রশাসনের উদাসীনতার সাঁড়াশি চাপে নাজেহাল ছোট ও মাঝারি সংস্থাগুলির কী হবে? রাজারহাটে জমি কিনে বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্তই ভুল হয়েছে বলে এখন মনে করছেন ওই সব সংস্থার কর্তারা। এমনই এক কর্তা ইংল্যান্ড থেকে ই-মেল করে তাঁর ক্ষোভ উগরে দিলেন। তাঁর অভিযোগ, এক দিকে নির্মাণসামগ্রী কেনার জন্য সিন্ডিকেটের চাপে বিপুল টাকা খেসারত দিতে হচ্ছে। অন্য দিকে জরিমানা মকুবের জন্য হিডকোর কাছে পরের পর চিঠি লিখেও উত্তর মেলেনি। তাঁর দাবি, এ ভাবে চলতে থাকলে রাজ্য থেকে বিনিয়োগকারীরা পালিয়ে যাবেন।

২০০৫-’০৬ সালে ছোট ও মাঝারি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার বিনিয়োগ টানতে বাম সরকার রাজারহাটে ৩০ একর জমি চিহ্নিত করেছিল। সেই জমি ৪৮টি সংস্থার মধ্যে বণ্টন করা হয়। জমির মাপ আধ থেকে দুই একরের মধ্যে। প্রথমে জমির হস্তান্তর নিয়ে সমস্যা ছিল। এর পরে জমি হাতে পেলেও লাগোয়া অঞ্চলে নিকাশি-জল-রাস্তার মতো ন্যূনতম পরিকাঠামোও ছিল না। পরবর্তী ধাপে বাড়ির নকশা অনুমোদন করাতেও প্রশাসনিক গড়িমসির মুখে পড়ে বলে বহু সংস্থার অভিযোগ। এ সবের জেরে কিছু সংস্থা জমি বিক্রিও করে দেয়।

Advertisement

এর পরেও যারা প্রকল্প তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেয়, তাদের সমস্যা বেড়েছে বই কমেনি। ছোট জমি। কম বাজেট। পরিকাঠামো তৈরি করতে গিয়ে কালঘাম ছুটে যাচ্ছে। পদে পদে সিন্ডিকেটের বাধায় নাজেহাল এক সংস্থার কর্তা বিদেশে ফেরত গিয়েছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই বিনিয়োগকারীর ক্ষোভ, এখনও পর্যন্ত দফায় দফায় দশ লক্ষ টাকার বেশি আদায় করেছে সিন্ডিকেট। আর প্রকল্প তৈরির কাজ শুরু না হওয়ায় ১৫ লক্ষ টাকা জরিমানা করেছে হিডকো। জরিমানা মকুব করার জন্য হিডকোর কাছে আর্জি জানিয়েছেন তাঁরা। আর একটি সংস্থা মাস কয়েক আগেই জরিমানার টাকা মিটিয়েছে। আপাতত রাজারহাটেই একটি বিশেষ তথ্যপ্রযুক্তি অঞ্চলে জায়গা নিয়ে অফিস করেছে সেই সংস্থা।

ছোট সংস্থাগুলির অভিযোগ, বড় সংস্থারা কিছুটা সুবিধা পেলেও ছোটরা তা থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত। এ প্রসঙ্গেই উঠেছে উইপ্রোর কথা। প্রায় দেড় লক্ষ কর্মীর সংস্থা উইপ্রোর কাছ থেকে রাজারহাটের জমির বকেয়া দাম চেয়েছিল হিডকো। সঙ্গে ছিল জরিমানা দেওয়ার হুকুমও। অর্থাৎ সময়ে টাকা না মেটানোর জন্য সুদ দেওয়ার নির্দেশ। পাল্টা চিঠি দেয় ৪৩,৭৬০ কোটি টাকার ব্যবসা করা উইপ্রো। ওই এক চিঠিতেই মকুব হয়ে যায় হিডকোর শাস্তি। তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পমহল হিডকোর এই সিদ্ধান্তকে স্বাগতই জানিয়েছে। তবে একই সঙ্গে তাদের বক্তব্য, ছোটদের ছাড় দেওয়া বেশি জরুরি। ন্যাসকমের এক সদস্যের মতে, বড় সংস্থা কোটি টাকার ধাক্কা সামলে নিতে পারে। যা ছোট সংস্থার পক্ষে সম্ভব নয়। হিডকো অবশ্য বৈষম্যের অভিযোগ মানতে নারাজ। সংস্থার চেয়ারম্যান দেবাশিস সেনের দাবি, জরিমানার কথা না ভেবে ছোট ও মাঝারি সংস্থাদের কাজ শুরু করতে বলা হয়েছে। কিন্তু সেই কাজে সিন্ডিকেট বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে কি না, সে প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গিয়েছেন তিনি।

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একাধিক বার বলেছেন, ছোট ও মাঝারি সংস্থার হাত ধরে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পে আসবে নয়া বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ। সেই লক্ষ্যেই জেলায় জেলায় তথ্যপ্রযুক্তি পার্ক তৈরি করছে রাজ্য সরকার। কিন্তু সিন্ডিকেটের দাপটে বাস্তবে সেই নীতি কতটা কার্যকর হচ্ছে, প্রশ্ন সেটাই। নির্মাণসামগ্রীর মতো দামি উপকরণ তো ছেড়েই দেওয়া গেল, এক সংস্থার কর্তার অভিযোগ, ইচ্ছা থাকলেও পছন্দের ব্র্যান্ডের জল কেনা যাবে না। সিন্ডিকেটের নির্ধারিত পানীয় জলই কিনতে হবে।

পুলিশ-প্রশাসনের কাছে অভিযোগ দায়ের হয়েছে? পাল্টা প্রশ্ন ছুটে আসে পুলিশ এ সব ছোটখাটো ঘটনাকে আমল দেবে? যদি বা দেয় পুলিশি পাহারায় কত দিন কাজ করা যাবে? ছোট থেকে মাঝারি সংস্থাগুলির তাই মাথায় হাত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন