শেষ তিন বছরেই বৃহস্পতি তুঙ্গে, দাবি তদন্তে

সামান্য প্রোমোটারি দিয়ে শুরু। সেটা ১৯৯৬ সাল। পরের বারো বছরে কারবারের আয়তন বাড়লেও তা নজরে পড়ার মতো কিছু ছিল না। কিন্তু বাঁধ-ভাঙা জোয়ার এল শেষ তিন বছরে। ২০১৩-র ২৩ এপ্রিল কাশ্মীরের সোনমার্গে যখন পুলিশের হাতে ধরা পড়লেন সুদীপ্ত সেন, সারদা গোষ্ঠীর তহবিল তত দিনে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা ছুঁইছুঁই! যার অন্তত ৯৫ শতাংশই এসেছে সারদা-সাম্রাজ্য পতনের আগের তিন বছরে!

Advertisement

অত্রি মিত্র

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:২৪
Share:

সামান্য প্রোমোটারি দিয়ে শুরু। সেটা ১৯৯৬ সাল।

Advertisement

পরের বারো বছরে কারবারের আয়তন বাড়লেও তা নজরে পড়ার মতো কিছু ছিল না। কিন্তু বাঁধ-ভাঙা জোয়ার এল শেষ তিন বছরে। ২০১৩-র ২৩ এপ্রিল কাশ্মীরের সোনমার্গে যখন পুলিশের হাতে ধরা পড়লেন সুদীপ্ত সেন, সারদা গোষ্ঠীর তহবিল তত দিনে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা ছুঁইছুঁই! যার অন্তত ৯৫ শতাংশই এসেছে সারদা-সাম্রাজ্য পতনের আগের তিন বছরে!

সারদা-কেলেঙ্কারি নিয়ে কেন্দ্রীয় সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের (ইডি) তদন্তেই উঠে এসেছে সুদীপ্ত সেনের রকেট-সদৃশ উত্থানের এই ছবি। ইডি-র কর্তারা জানাচ্ছেন, গত বছরের ১৬ এপ্রিল সারদা-সাম্রাজ্যে তালা ঝুলে যাওয়ার আগে সব মিলিয়ে ৫ বছর ১৬ দিনে আমানতকারীদের থেকে ২৪৬০ কোটি টাকা তোলে সুদীপ্তবাবুর সংস্থা। এর মধ্যে শেষের তিন বছরে (২০১০-১১ থেকে ২০১২-১৩) আদায় হয়েছে ২৩১৬ কোটি ৫২ লক্ষ টাকা। অর্থাৎ, মোট আদায়ের ৯৫.২০%! এবং সারদা-কর্ণধার জেলে যাওয়ার মুহূর্তে সারদাগোষ্ঠীর হাতে ছিল ২৩৯টি কোম্পানি, ১৬ হাজার কর্মী ও কয়েক লক্ষ আমানতকারী।

Advertisement

কিন্তু প্রায় শূন্য থেকে শুরু করা সুদীপ্ত সেন এত কম সময়ে কী ভাবে এমন জায়গায় পৌঁছালেন?

ইডি-সূত্রের দাবি: জেরায় সুদীপ্ত সেন জানিয়েছেন, সংস্থার ‘ভাবমূর্তি’ বাড়াতে তিনি পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিকেও সুকৌশলে কাজে লাগিয়েছেন। যেমন, জঙ্গলমহলে রাজ্য সরকারের সঙ্গে একটি যৌথ প্রকল্পে সারদা সামিল হয়েছিল, মহাকরণে বোতাম টিপে যার সূচনা করেছিলেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর সেই উদ্বোধনের ছবি পরবর্তী কালে আমানত সংগ্রহে তাঁদের সাহায্য করেছে বলে জানিয়েছেন সারদা-কর্তা। ইডি’র তদন্তকারীদের এ-ও দাবি, গ্রামে-গঞ্জে অর্থলগ্নির অবৈধ কারবার বিস্তারের ক্ষেত্রে সারদা গোষ্ঠী ‘ঢাল’ হিসেবে ব্যবহার করেছে মূলত শাসকদলের লোকজনকে, যাঁরা সারদার সঞ্চয়-প্রকল্পে টাকা ঢালার জন্য আমজনতাকে উৎসাহিত করে গিয়েছেন বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন ভাবে।

ইতিমধ্যে পশ্চিমবঙ্গে লোকসভা ভোটের বাজারে বিরাট ছায়া ফেলেছে সারদা-কাণ্ড। সারদার বেআইনি লগ্নি কারবারে বাড়বাড়ন্তের জন্য কে দায়ী, তা নিয়ে নিত্য দিন চলছে চাপান-উতোর। বিজেপি’র প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদীর পাশাপাশি রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল সিপিএমের নেতৃবৃন্দ সারদা প্রসঙ্গে প্রায় এক সুরে শাসক তৃণমূলকে আক্রমণ করছেন। পিছিয়ে নেই কংগ্রেসও। অন্য দিকে তৃণমূলনেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতার অভিযোগ, পশ্চিমবঙ্গে সারদা-সহ একাধিক বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থা পূর্বতন বাম আমলেই গজিয়ে উঠেছে। পাল্টা আক্রমণে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের দাবি, জন্মালেই কেউ অপরাধী হয়ে যায় না।

চাপান-উতোরের এ হেন তপ্ত আবহের মধ্যে চলছে ইডি’র তদন্ত। দিন কয়েক আগে গ্রেফতার হয়েছেন সুদীপ্তের প্রথম পক্ষের ছেলে শুভজিৎ ও দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী পিয়ালি সেন। শুভজিৎ ওরফে রাজার স্ত্রী প্রিয়াঙ্কাকেও ইডি-অফিসে ডেকে এনে দীর্ঘ জেরা করা হয়েছে। এ দিকে সারদা-কেলেঙ্কারির সিবিআই-তদন্ত চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে দায়ের মামলার চূড়ান্ত রায় স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। এরই মধ্যে সন্তোষপুরের সার্ভে পার্কের একদা বাসিন্দা শঙ্করাদিত্য সেনের সুদীপ্ত সেনে রূপান্তরের ইতিহাস ঘাঁটতে গিয়ে যে সব তথ্য উঠে আসছে, সেগুলোও কম চাঞ্চল্যকর নয় বলে দাবি করছেন ইডি’র তদন্তকারীরা।

কী রকম? ইডি-র অনুসন্ধান বলছে, ব্যবসায় সারদা-কর্তার হাতেখড়ি আঠারো বছর আগে। ১৯৯৬-এ সামান্য পুঁজি নিয়ে তিনি প্রোমোটারিতে নেমেছিলেন। নিজের মালিকানার প্রথম কোম্পানিটির নাম রেখেছিলেন সারদা কনস্ট্রাকশন প্রাইভেট লিমিটেড। ব্যবসা বাড়ানোর তাগিদে তিন বছর বাদে একই দিনে খুলে ফেলেন আরও দু’টো কোম্পানি শুভজিৎ কনস্ট্রাকশন (ছেলের নামে) এবং বেহালা সারদা কনস্ট্রাকশন। তদন্তকারীদের তথ্যানুযায়ী, প্রোমোটারি, হোটেল ও পর্যটনের কারবারে জড়িত সারদার এই তিন ‘আদি সংস্থা’ কখনও লাভের মুখ দেখেনি। অগত্যা দিশা বদল। ইডি-র দাবি, এই পথে রোজগার কঠিন বুঝেই জমির কারবারে হাত পাকাতে শুরু করেন সুদীপ্ত। তাঁর নজর পড়ে দক্ষিণ শহরতলির বিষ্ণুপুরে সারদা গার্ডেন আবাসন প্রকল্পে। প্রকল্পটির মালিক ছিলেন বিশ্বনাথ অধিকারী। সুদীপ্তও ওই সংস্থায় ডিরেক্টর হিসেবে ছিলেন। তিনি জমি-বাড়ির কারবারে জোরকদমে নামার পরে সংস্থাটি সেখানকার তিন মৌজার প্রায় হাজার বিঘে জমি জবরদস্তি দখল করে নেয় বলে অভিযোগ। এখানেই শেষ নয়। ২০০১-এ বিশ্বনাথবাবু খুন হয়ে যান। অভিযোগ, এর পরেই সারদা গার্ডেন সুদীপ্ত সেনের কব্জায় চলে আসে।

গোয়েন্দারা তদন্তে জেনেছেন, ২০০৭ পর্যন্ত জমি-বাড়ির কারবার চালিয়ে সুদীপ্তের বেশ কিছু পুঁজি হয়েছিল। ২০০৮-এ তিনি হাত দেন অবৈধ অর্থলগ্নির কারবারে, যার দৌলতে তার ধূমকেতুর মতো উত্থান। পতনও। আমানতকারীদের সামনে সারদার টোপ ছিল, তিন থেকে পাঁচ বছর মেয়াদে টাকা জমা রাখলে সুদ মিলবে ১৮% হারে। আর যাঁরা বিনিয়োগ আনবেন, সেই এজেন্টরা কমিশন পাবেন ৩৫%। অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়মে যা কার্যত অসম্ভব।

কিন্তু বাস্তবের পরোয়া না-করে, বিপুল লাভের আশায় সুদীপ্তের পাতা ফাঁদে পা দিয়েছিলেন লক্ষ লক্ষ আমানতকারী। ইডি’র তদন্তে প্রকাশ, রাজ্যে পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সারদার নতুন ব্যবসা ফুলে-ফেঁঁপে উঠতে থাকে। তবে মিথ্যের ফানুস ফাটতে বিশেষ দেরি হয়নি। পাঁচ বছরের মধ্যে ধূলিসাৎ হয়ে যায় সারদা-সৌধ।

উত্থান যেমন, পতনটাও ঠিক ধূমকেতুর মতো!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন