কোথাও কিছু ঘটলেই বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের নাম জড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। অথচ পুলিশের খাতায় অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও শাসক দলের নেতা-বিধায়করা অধরা! রায়দিঘি ও লাভপুর-কাণ্ডের প্রসঙ্গ টেনে বামফ্রন্ট এ বার প্রশাসনের এই বৈষম্যের প্রতিবাদে সরব হল বিধানসভায়।
রায়দিঘিতে চার জনের খুনের পিছনে স্থানীয় বিবাদ দায়ী এবং তাতে তৃণমূলের এক স্থানীয় নেতার ভূমিকা আছে বলে অভিযোগ নিহত ও আহতদের পরিজনদেরই। অথচ ওই ঘটনায় এফআইআর হয়েছে রায়দিঘির প্রাক্তন বিধায়ক সিপিএমের কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়-সহ ২১ জনের নামে। দলের শিক্ষক-নেতা বিমল ভাণ্ডারীকে ইতিমধ্যে গ্রেফতারও করা হয়েছে। আর লাভপুরে সিপিএম সমর্থক তিন ভাইকে তিনি পিষে মেরেছেন বলে নিজেই প্রকাশ্যে ঘোষণা করার পরেও মূল চার্জশিটে নাম নেই স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক মনিরুল ইসলামের!
এ ভাবে শুধু বিরোধীদের ফাঁসানো ও শাসক দলের বিধায়কদের আইনি প্রক্রিয়া থেকে ছাড় পাওয়া নিয়ে শুক্রবার বিধানসভায় মুলতবি প্রস্তাব আনতে চেয়েছিলেন আনিসুর রহমান-সহ বাম বিধায়করা।
নির্দিষ্ট বিষয়ের উপরে আনা হয়নি, এই যুক্তিতে স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় তা গ্রহণ করেননি। প্রতিবাদে ওয়াক আউট করেন বামেরা। পরে রায়দিঘির চার এবং লাভপুরের তিন খুনের প্রসঙ্গ এনে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র মন্তব্য করেন, “বোঝাই যাচ্ছে, শাসক দল হলে সাত খুন মাফ!”
লোকসভা ভোটে বুথে ঢুকে প্রিসাইডিং অফিসারকে মারধরের অভিযোগে এফআইআর হয়েছে বাঁকুড়ার সোনামুখীর বিধায়ক দীপালি সাহার নামে। ভোটের দিন উত্তর ২৪ পরগনার হাড়োয়ায় বুথমুখী ভোটারদের উপরে গুলি চালানোর ঘটনায় নাম জড়িয়েছে মিনাখাঁর তৃণমূল বিধায়ক ঊষারানি মণ্ডলের। দলীয় নেতৃত্বের পরামর্শেই জামিনের প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগে বিধানসভায় আসছেন না দুই বিধায়ক। কয়েক দিন ধরে অধিবেশনে অনুপস্থিত মনিরুলও। এই অভিযুক্ত বিধায়কদের নিয়ে এ দিন সরব হন বামেরা। ‘ফেরার’ বিধায়কদের আইনের হাতে তুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে স্পিকারেরও ভূমিকা আছে বলে সূর্যবাবুর দাবি। তাঁর কথায়, “শাসক দলের কয়েক জন বিধায়ক বেআইনি কাজ করেছেন। আইন-কানুন কিছুই তাঁদের জন্য নয়!”
প্রশাসনের বৈষম্য নিয়ে বামেদের হইচইয়ের সময় মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিধানসভায় ছিলেন না। মুখ্যমন্ত্রীর জন্য শুক্রবারের নির্ধারিত পুলিশ দফতর সংক্রান্ত প্রশ্নও এ দিন ফের গ্রহণ না-করেই বাতিল করা হয়েছিল। বিরোধী দলনেতা এ নিয়ে বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীর আসার আশা আমরা ছেড়ে দিয়েছি। ভয় পাচ্ছেন বলেই উনি আমাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে চাইছেন না!” যদিও প্রথমার্ধের অধিবেশন শেষ হওয়ার কিছু আগেই বিধানসভায় এসে মুখ্যমন্ত্রী এ দিন জলপাইগুড়ি জেলা ভাগের ঘোষণা করেন।
বামেরা তত ক্ষণে প্রতিবাদ করে সভার বাইরে।
বিধানসভায় মমতা বামেদের অভিযোগ নিয়ে মুখ খোলেননি। তবে রায়দিঘিতে ৪ জনের খুনের ঘটনায় বিরোধীদের ফাঁসানোর অভিযোগ নিয়ে বিতর্কের মুখে তিনি দক্ষিণ ২৪ পরগনার দলীয় বিধায়কদের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, আজ, শনিবার তিনি নিজেই রায়দিঘি যেতে পারেন।
সন্ধেয় অবশ্য খারাপ আবহাওয়ার কারণ দেখিয়ে সেই পরিকল্পনা বাতিল করেন তিনি। জলপাইগুড়ি যেতে হচ্ছে বলে ২৬ জুন দক্ষিণ ২৪ পরগনায় তাঁর সরকারি অনুষ্ঠানও স্থগিত থাকছে। ১ জুলাই রায়দিঘি যেতে পারেন মমতা।
লাভপুরের ঘটনা নিয়ে সূর্যবাবুদের অভিযোগ, এর আগে রাজ্যের এক মন্ত্রীর নামও একটি খুনের ঘটনায় চার্জশিট থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। এর জবাবে তৃণমূলের বিধায়করা অবশ্য বলেছেন, বিধানসভার বাইরের বিষয়ে তাঁদের কিছু বলার নেই।
সিপিএমের বীরভূম জেলা নেতৃত্ব এ দিন জেলার পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়ার সঙ্গে দেখা করে লাভপুর-কাণ্ডের চার্জশিটে অবিলম্বে মনিরুলের নাম যোগ করার দাবি জানান। সিপিএম এ দিন সিউড়িতে ধিক্কার মিছিলও করে চার্জশিটে মূল অভিযুক্ত মনিরুলের নাম না-রাখার প্রতিবাদে। মিছিলে ছিলেন নিহতদের ভাই সানোয়ার শেখের স্ত্রী আঙুরা বিবি এবং মজল শেখের স্ত্রী আফরোজা বিবি। তাঁরা বলেন, “এসপি বিষয়টি পুনর্বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছেন। তাতেও কাজ না দিলে, যতদূর সম্ভব যাব! দল আমাদের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছে।” এসপি বলেছেন, “সিপিএমের দাবিপত্র পেয়েছি। বিষয়টি দেখছি।”
পুলিশ বুধবারই ওই মামলায় অস্ত্র আইনের ধারায় অতিরিক্ত চার্জশিটে ওই বিধায়কের নাম ঢোকানোর জন্য প্রয়োজনীয় অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছে জেলাশাসকের কাছে। জেলাশাসক পি মোহন গাঁধী এ দিন বলেন, “এখনও ওই অনুমতি দিইনি। বিষয়টি খতিয়ে দেখেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেব।” এ বিষয়ে মনিরুলের প্রতিক্রিয়ার জন্য যোগাযোগ করা হলে তাঁর বড় ছেলে আশিক ইকবাল ফোন ধরে বলেন, “বাবা অসুস্থ। কথা বলার অবস্থায় নেই। সুস্থ হলে যোগাযোগ করবেন।”