বর্ধমান-বিস্ফোরণ

সোনা, গাঁজা পাচারের টাকায় জেহাদের প্রস্তুতি

চোরাপথে সীমান্ত পেরিয়ে আসা গাঁজা ও সোনার বিস্কুট বিক্রি করে পাওয়া টাকা দিয়ে কেনা হতো বিস্ফোরক। খরচ হতো জঙ্গি প্রশিক্ষণেও। বিভিন্ন জঙ্গি ঘাঁটির লোকেরা নির্দিষ্ট একটি জায়গায় গিয়ে নিয়ে আসত সেই টাকা। আবার একই জায়গা থেকে বাংলাদেশে পাচার করা হতো পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন ঘাঁটিতে তৈরি হওয়া মারণাস্ত্র। জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ)-র মতে, মুর্শিদাবাদ জেলার লালগোলার মকিমনগরে ঘাঁটি গেড়ে বসে এই দ্বিমুখী দায়িত্ব নিপুণ ভাবে সামলাচ্ছিল জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ-এর এক সদস্য। নাম সাজিদ।

Advertisement

জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ অক্টোবর ২০১৪ ০৩:০২
Share:

চোরাপথে সীমান্ত পেরিয়ে আসা গাঁজা ও সোনার বিস্কুট বিক্রি করে পাওয়া টাকা দিয়ে কেনা হতো বিস্ফোরক। খরচ হতো জঙ্গি প্রশিক্ষণেও। বিভিন্ন জঙ্গি ঘাঁটির লোকেরা নির্দিষ্ট একটি জায়গায় গিয়ে নিয়ে আসত সেই টাকা। আবার একই জায়গা থেকে বাংলাদেশে পাচার করা হতো পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন ঘাঁটিতে তৈরি হওয়া মারণাস্ত্র। জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ)-র মতে, মুর্শিদাবাদ জেলার লালগোলার মকিমনগরে ঘাঁটি গেড়ে বসে এই দ্বিমুখী দায়িত্ব নিপুণ ভাবে সামলাচ্ছিল জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ-এর এক সদস্য। নাম সাজিদ।

Advertisement

শুক্রবারই এনআইএ এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, বর্ধমানের খাগড়াগড়ে জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি)-এর সদস্যরাই আইইডি তৈরি করে সেগুলি বাংলাদেশে পাচার করে আসছিল। বিস্ফোরণের তদন্তে নেমে জেএমবি-র বিভিন্ন দিক, বিশেষ করে জঙ্গি কার্যকলাপের জন্য অর্থের জোগান কোথা থেকে আসত, তা খতিয়ে দেখছেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা। সূত্রের দাবি, মকিমনগরের একটি মাদ্রাসা থেকেই পশ্চিমবঙ্গ ও অসমে জেএমবি-র কার্যকলাপের জন্য অর্থ বণ্টন করা হতো। দুই রাজ্যে জেএমবি-র কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করা হত ওই মাদ্রাসা থেকেই। এবং সেখানেই প্রমীলা বাহিনীকে আগ্নেয়াস্ত্র চালানো-সহ বিভিন্ন ধরনের জেহাদি প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো।

গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন, খাগড়াগড় কিংবা বেলডাঙার গবেষণাগারে তৈরি হওয়া গ্রেনেড ও সকেট বোমা বাংলাদেশে ঢোকার ঠিক আগে এসে পৌঁছত মকিমনগরে সাজিদের কাছে। সাজিদ নিজস্ব যোগাযোগের মাধ্যমে সে সব বিস্ফোরক সীমান্ত পার করাত। আবার জঙ্গি ডেরা, পরীক্ষাগার, প্রশিক্ষণকেন্দ্র অথবা আইইডি মজুত রাখার গোপন গুদাম কেনা ও ভাড়া নেওয়ার টাকা বণ্টনের দায়িত্বে সে-ই ছিল। জেহাদিদের মাসোহারাও সাজিদ দিত। তার কাছ থেকে টাকা আনতে ইউসুফ, কওসর, কদর, কালাম-রা মকিমনগর যেত বলে এনআইএ-র দাবি। এক গোয়েন্দা-কর্তা জানান, সাজিদের কাছ থেকে চোরাচালানের টাকা জেহাদি কার্যকলাপের জন্য বর্ধমানের খাগড়াগড়, শিমুলিয়া ও কৃষ্ণবাটী, নদিয়ার করিমপুরের বারবাকপুর, মুর্শিদাবাদের বেলডাঙার বড়ুয়া মোড়, বীরভূমের কীর্ণাহার ও অসমের বরপেটায় পৌঁছেছে।

Advertisement

ইউসুফ, কওসরদের মতো সাজিদও এখন ফেরার। বিস্ফোরণের দু’দিন পর লালগোলা থেকে বেপাত্তা হয়ে যায় ওই বাংলাদেশি। তার সন্ধান পেতে স্কেচ আঁকিয়ে ছড়িয়ে দেওয়া এবং কয়েক লক্ষ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করার কথা ভাবছে এনআইএ। তদন্তকারীদের বক্তব্য, বিস্ফোরণে নিহত শাকিল আহমেদ যেমন বছর সাতেক আগে এ দেশে ঢুকে নদিয়ার করিমপুরের তরুণী রাজিয়া বিবিকে বিয়ে করেছিল এবং ভুয়ো পরিচয়পত্র জোগাড় করেছিল, সাজিদও তেমন বাংলাদেশ থেকে তাড়া খেয়ে প্রায় একই সময়ে ভারতে ঢুকেছিল।

এনআইএ জানিয়েছে, শাকিলের মতো সাজিদও ভোটার কার্ড, এমনকী ভারতীয় পাসপোর্টও জোগাড় করেছিল। তবে তার নাম সত্যিই সাজিদ নাকি অন্য কিছু, সেই ব্যাপারে তদন্তকারীদের সন্দেহ আছে। এক অফিসার বলেন, “বাংলাদেশে জেএমবি-র চাঁইদের অনেকেরই তিন-চারটি নাম আছে। কোনটা তাদের আসল নাম, বের করা মুশকিল। মনে হচ্ছে সাজিদ-ও লোকটির আসল নাম নয়।” এনআইএ-র দাবি, জেরায় আলিমা ও রাজিয়া বলেছে, ‘সাজিদ সাহেব’ ছিল আসল ‘আদমি’। তাদের বক্তব্য, বিস্ফোরণে নিহত শাকিল ও সুবহান বারবার সাজিদের কথাই বলত।

তদন্তকারীদের একাংশের বক্তব্য, বাংলাদেশে থেকে হুন্ডির মাধ্যমে কিছু টাকা আসত। পাশাপাশি চোরাপথে গাঁজা ও সোনার বিস্কুট বাংলাদেশ থেকে নিয়ে এসে বিক্রি করেও তোলা হতো টাকা। গত কয়েক বছর ধরে লালগোলা সীমান্ত দিয়ে বিপুল পরিমাণ গাঁজা এবং সোনা এ দেশে ঢুকেছে। যদিও বিএসএফ বাংলাদেশ থেকে এ পারে ঢোকা বিপুল পরিমাণ গাঁজা ও সোনার বিস্কুট বাজেয়াপ্ত করেছে। তবে এনআইএ-র বক্তব্য, যে পরিমাণ গাঁজা ও সোনার বিস্কুট চোরাপথে ঢোকে, তার সামান্য অংশই ধরা পড়ে। লালগোলা সীমান্তে বিএসএফের ভূমিকাও এ ক্ষেত্রে খতিয়ে দেখা হতে পারে বলে জানিয়েছে তারা।

গোয়েন্দারা বলছেন, এক যুগেরও বেশি আগে, ২০০১ সালে সিআইডি-র তদন্তে বেরিয়েছিল, খাদিম কর্তা পার্থ রায়বর্মনের মুক্তিপণের টাকার অংশ ৯/১১-র চাঁই মহম্মদ আটার কাছে পৌঁছেছিল। অপহরণকারীদের মতো খুচরো অপরাধীদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদীদের আঁতাঁতের কথা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল সে সময়ে। খাগড়াগড় বিস্ফোরণে জেএমবি-র কার্যকলাপ প্রকাশ্যে আসায় একই ভাবে সেই অপরাধ জগৎ ও সন্ত্রাসবাদীদের যোগসাজশের কথা জানা যাচ্ছে। তবে এ বার অপহরণকারীদের সঙ্গে নয়, জঙ্গিরা হাত মিলিয়েছে চোরাকারবারিদের সঙ্গে।


পাকড়াও আরও এক
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা

বর্ধমান কাণ্ডে এ বার সরাসরি যুক্ত হল কলকাতা। শনিবার রাতে কলকাতা পুলিশের স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্সের দল দিল্লি থেকে আমজাদ আলি শেখ নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে। ধৃত ব্যক্তির বিরুদ্ধে বর্ধমানে বিস্ফোরক পাচারের অভিযোগ রয়েছে। খাগড়াগড় কাণ্ডের পর থেকেই ফেরার

ছিল আমজাদ। তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছিলেন তদন্তকারীরা। তদন্তকারীরা জানতে পেরেছেন, ধৃত আমজাদ কলকাতার শেক্সপিয়র সরণির একটি সংস্থায় কাজ করতেন। ওই সংস্থার মহেশতলায় একটি অফিস রয়েছে। সেই অফিস সে দেখভালও করত। এই সংস্থাটিতে চিকিৎসার সরঞ্জাম শোধন করা হতো। এই কাজের জন্য বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্যের প্রয়োজন হয়। বাগুইআটি এলাকার রাসায়নিক দ্রব্যের পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কিনে সে খাগড়াগড়ে পাঠাত বলে সন্দেহ তদন্তকারীরা। আমজাদের বাড়িও বীরভূমে। সে শাকিলদের রাসায়নিক দ্রব্য পাচার করত বলেই প্রাথমিক অনুমান। গত এক বছরে সে বেশ কয়েক বার কলকাতা থেকে খাগড়াগড়ে রাসায়নিক পৌঁছে দিয়েছে বলেও মনে করা হচ্ছে। কী ভাবে খোঁজ মিলল আমজাদের? এনআইএ-র তদন্তকারীরা খাগড়গড় বিস্ফোরণ স্থল থেকে একটি ভিজিটিং কার্ড পেয়েছিলেন। তাতে কওসরের নাম এবং কলকাতার শেক্সপিয়র সরণির একটি সংস্থার ঠিকানা ছিল। সেই ঠিকানা ধরে তদন্ত চালিয়ে আমজাদের বিষয়ে তথ্য মেলে। সে যে খাগড়াগড় বিস্ফোরণের পর থেকে নিখোঁজ, তা-ও জানা যায়।

এর পরেই শুরু হয় খোঁজ। তদন্তকারীদের বক্তব্য, আমজাদ খাগড়াগড়ে যা পৌঁছে দিত, তা নিষিদ্ধ রাসায়নিক নয়। তবে সেগুলির সঙ্গে অন্য রাসায়নিক মিশিয়ে বিস্ফোরক তৈরি করা সম্ভব। বৃহস্পতিবার গোয়েন্দারা জানতে পারেন, আমজাদ সম্ভবত দিল্লিতে। কলকাতা থেকে এসটিএফের একটি দল তাঁকে দিল্লিতে খুঁজতে যায়। সেখানেই ধরা পড়ে আমজাদ।

শনিবার গভীর রাত পর্যন্ত দফায় দফায় আমজাদকে জেরা করেন এসটিএফের তদন্তকারীরা। জেরা করে তাঁরা জানতে পেরেছেন, খাগড়াগড়ে কাপড় কাচার সাবান পৌঁছে দিত আমজাদ। তবে তার সঙ্গে খাগড়াগড় বিস্ফোরণের কতটা যোগাযোগ রয়েছে, তা নিয়ে এই দিন রাতে কোনও নির্ভরযোগ্য তথ্য আসেনি এসটিএফের তদন্তকারীদের হাতে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন