বাংলার মসনদে তখন জ্যোতি বসু। জাতীয় রাজনীতিতেও তাঁর প্রভাব তখন ছড়িয়ে পড়েছে। দেশের অ-কংগ্রেস সরকারের বিভিন্ন মুখ্যমন্ত্রীকে ডেকে কলকাতায় ‘অপোজিশন কনক্লেভ’ করেছিলেন সে বার। পর দিন সকালে দিল্লির উড়ান ধরার জন্য বিমানবন্দরে যাওয়ার পথে ফারুখ আবদুল্লাকে কালো পতাকা দেখিয়েছিল কংগ্রেস। তারাই তখন এ রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল। বিক্ষোভ দেখানোর অপরাধে গ্রেফতার হয়েছিলেন প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি, সোমেন মিত্র এবং সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু সেখানেই শেষ নয়। বাম সরকারের পুলিশ তাঁদের বিরুদ্ধে ‘খুনের চেষ্টা’র অভিযোগ এনেছিল!
রাজনৈতিক বিক্ষোভ দেখাতে গিয়ে বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ দায়েরের ঘটনায় রাজ্য সে দিন উত্তাল হয়েছিল। রাস্তা স্তব্ধ হয়েছিল। পুলিশি আচরণের প্রতিবাদে প্রিয়-সোমেনেরা প্রথমে জামিনের আবেদনই করেননি। প্রাথমিক ভুল বুঝে পুলিশও অবশ্য তাঁদের বিরুদ্ধে চার্জশিট ফাইল করেনি। আদালতও তাঁদের সসম্মানে মুক্তি দিয়েছিল।
এই উদাহরণ ১৯৮৩ সালের ডিসেম্বরের। পরের তিন দশকে দেশ ও রাজ্যের রাজনীতিতে অনেক জল বয়ে গিয়েছে। কিন্তু প্রতিপক্ষকে ‘মিথ্যা’, তুচ্ছ মামলায় ‘ফাঁসিয়ে’ দেওয়ার পরম্পরার বিরাম নেই! আসানসোলের বিজেপি প্রার্থী, বিখ্যাত গায়ক বাবুল সুপ্রিয়ের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা রুজুর ঘটনা সেই পরম্পরার এগিয়ে চলারই সাক্ষ্য বহন করছে বলে বিরোধী শিবিরের রাজনৈতিক নেতারা মনে করছেন! পরম্পরার শুরু অবশ্য আরও আগে। সাতের দশকে জরুরি অবস্থার সময়ে জয়প্রকাশ নারায়ণ, জে বি কৃপালনি-সহ অগুনতি নেতা জেলে গিয়েছেন। পুত্র সঞ্জয় তখন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধীর ডান হাত। তাঁর কথাই তখন আইন! আবার ইন্দিরার সরকার হেরে যাওয়ার পরে সেই সঞ্জয়ই ‘কিস্সা কুর্সি কা’ ছবির প্রিন্ট পুড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগে কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন। অকাল-মৃত্যুর আগেই উচ্চ আদালতের গিয়ে সেই কারাবাসের আদেশ অবশ্য রদ করাতে পেরেছিলেন সঞ্জয়।
এ রাজ্যে বাম জমানায় কংগ্রেস ছিল বিরোধী আসনে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমলেও তারা এখন সেখানেই। কংগ্রেস শিবিরের নেতাদের অভিজ্ঞতা বলছে, বাম আমলে যা হতো অনেক সূক্ষ্ম ভাবে, চোখের পর্দার বালাই রেখে, পরিবর্তনের জমানায় তা একেবারে খুল্লম খুল্লা! এ বার শ্রীরামপুর লোকসভা কেন্দ্রের কংগ্রেস প্রার্থী আব্দুল মান্নানের কথায়, “আমার বিরুদ্ধে প্রায় ৩০ বছর খুনের চেষ্টার মামলা ছিল। অধীর চৌধুরীকে বাম আমলেও মামলায় হয়রান করার চেষ্টা হয়েছিল। তবে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তিন বছরে এ ব্যাপারে সিপিএম-কে ছাড়িয়ে গিয়েছেন!” সিপিএম রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুর দাবি, তৃণমূলের তিন বছরে নানা
স্তরে প্রায় ৪০ হাজার ‘মিথ্যা মামলা’ দায়ের হয়েছে!
যাঁরা এই মতের প্রবক্তা, তাঁরা একের পর এক শিলাদিত্য চৌধুরী, অম্বিকেশ মহাপাত্র বা তার পাশাপাশি রাজনৈতিক স্তরে অধীর, গৌতম দেব, সুজন চক্রবর্তীদের নাম বলে যেতে পারেন। তৃণমূলের জমানায় এঁদের সকলের বিরুদ্ধেই কোনও না কোনও অভিযোগে মামলা হয়েছে। কোনও অভিযোগই এখনও প্রমাণিত হয়নি। তবে পুলিশ সূত্রের ব্যাখ্যা, মামলা হয় কোনও না কোনও অভিযোগে। তদন্তের পরে সেই মামলা আদালতে যায়। যত উদাহরণ এখন মনে করা যায়, তার অধিকাংশ মামলারই এখনও আদালতে চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি। কাজেই মিটে যাওয়ার আগে কোনও মামলাকে আনুষ্ঠানিক ভাবে ‘মিথ্যা’ তকমা দেওয়া যায় না। এই সংক্রান্ত বিতর্ক আইনের চোখে তাই পুরোটাই নির্ভরশীল পারস্পরিক দাবি ও পাল্টা দাবির উপরে।
এসইউসি-র যেমন দাবি, তাদের বিধায়ক প্রবোধ পুরকায়েতকে ‘মিথ্যা মামলা’য় ফাঁসিয়েছিল সিপিএম। কিন্তু আদালতের রায়ে খুনের মামলায় দোষী স্যবস্ত হয়ে প্রবোধবাবু যাবজ্জীবন জেল খাটছেন। মমতার জমানায় লক্ষ্মণ শেঠ, সুশান্ত ঘোষেরাও অভিযোগ করেছেন, তাঁদের ‘ফাঁসানো’ হয়েছে। আদালতে এখনও নিষ্পত্তি হয়নি। তবু লক্ষ্মণ-সুশান্তদের বিরুদ্ধে এলাকায় দীর্ঘ দিন ধরে নানা অভিযোগ ছিল। বাবুলের ক্ষেত্রে এ সব রেকর্ডই ছাড়িয়ে গিয়েছে বলে বিরোধীদের অভিযোগ! তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য ব্যাখ্যা দিয়েছেন, “আমরা বারবারই বলছি, আইন আইনের পথে চলবে। বাবুল সুপ্রিয় বলে আলাদা কিছু হবে না। দোষ করে থাকলে বিচার হবে। রাজনৈতিক পতাকার রং সেখানে বিচার করা হবে না।”
কিন্তু বাস্তবে তা-ই হচ্ছে কি? সিপিএমের এক পলিটব্যুরো সদস্যের বক্তব্য, “কংগ্রেস আমলে জ্যোতি বসু জেলে গিয়েছেন। আমাদের সময়েও কোনও কোনও ঘটনায় প্রশাসনিক বাড়াবাড়ি হয়েছে। কিন্তু বিরোধী নেতা-নেত্রীদের মামলা দিয়ে হয়রান করব, এই মানসিকতা ছিল না!”
এই মতের উদাহরণ হিসেবে আসছে বছর পনেরো আগে বারাসতের সেই ঘটনা। যেখানে বিরোধী নেত্রী মমতার সমাবেশ ঘিরে গোলমালে পুলিশের গুলিতে এক জনের মৃত্যু হয়েছিল। অভিযোগ হয়েছিল মমতার নামে। গত বার বিধানসভা ভোটের আগে সিপিএমের স্থানীয় কিছু নেতা তৃণমূল নেত্রীর বিরুদ্ধে সেই পুরনো মামলা খুঁচিয়ে তোলার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলেছিলেন, “কবে কী হয়েছিল, তা দিয়ে এখন ভোটের সময় ওঁকে বিরক্ত করার প্রশ্নই ওঠে না! বলে দিয়েছি, এ সব হবে না!”
একটি বেসরকারি সংস্থার তথ্য বলছে, এ বারের লোকসভা ভোটে মোট যত প্রার্থী আছেন, তাঁদের এক-পঞ্চমাংশের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগ আছে। কিন্তু অভিযুক্ত প্রার্থীদের অধিকাংশেরই পাল্টা দাবি, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়েছে। ঠিক যেমনটা হতো ১৯৫০-এর দশকের আমেরিকায়। উইসকনসিনের সেনেটর জোসেফ ম্যাকার্থির উদ্যোগে তখন হাজার হাজার মানুষের গায়ে কমিউনিস্ট তকমা সেঁটে দিয়ে লাগাতার জেরা এবং তদন্তের মুখে ফেলে দেওয়া হতো। বাদ যাননি নামকরা শিল্পী-বুদ্ধিজীবীরাও। গোটা পৃথিবী জুড়ে সমালোচিত হয়েছিল সেই ‘ম্যাকার্থিজম’।
আমেরিকায় অবশ্য অভিযোগ ভুল প্রমাণ করতে পারলে অভিযোগকারীর (সরকারি হোক বা সাধারণ নাগরিক) কাছ থেকে পাল্টা জরিমানা আদায় করার প্রথা আছে। যার চল এ দেশে এখনও তেমন হয়নি। জঙ্গিপুরের কংগ্রেস প্রার্থী, রাষ্ট্রপতি-পুত্র অভিজিৎ মুখোপাধ্যায় যে কারণে ভেবে রেখেছেন, এ বার জিতলে সংসদে এক ধরনের ‘অ্যাকাউন্টেবিলিটি ক্লজ’ আনতে চান। ‘মিথ্যা’ অভিযোগ প্রমাণিত হলে অভিযোগকারীর শাস্তির বিধান যেখানে নিশ্চিত করা থাকবে।
প্রতিকারের আশা যতই দূর অস্ত হোক, রাজ্য রাজনীতিতে এই নিয়ে বিতর্ক আপাতত অব্যাহত। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর বলছেন, “মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচনে তাঁর দলের যত বেশি অনিশ্চয়তা দেখছেন, তত বেশি স্বৈরাচারী হয়ে উঠছেন!” বিমানবাবু বলছেন, “নিজেদের ওঁরা (তৃণমূল) সততার প্রতীক বলতেন। মানুষ এখন ওঁদের চেহারা চিনতে পারছেন। তাই মিথ্যা মামলা দিয়ে অন্যকে বিপদে ফেলতে চাইছেন।”